ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
কেবলমাত্র ১৬ বছর পর্যন্ত গ্রাহক-গ্রাহিকা ও পাঠক-পাঠিকাদের জন্য
জিত সবে গল্পের বইটা হাতে নিয়ে জানলার ধারে জুতসই একটা কোণা খুঁজে গুছিয়ে বসেছে এমন সময় রাস্তা দিয়ে দেখা গেল পিওন ছেলেটা যেন তার বাড়ি লক্ষ্য করেই হনহনিয়ে হেঁটে আসছে। একতাড়া কাগজের বান্ডিল একহাতে। অজিতের মনটা সহসা পুলকিত হয়ে আবার দমে গেল। নাঃ পেরিয়ে চলে যাচেছ যে... তবু চেঁচিয়ে ডাকল, ‘‘ও পিওন দাদা শুনছ??’’ ছেলেটা থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। ‘‘আমার নামে চিঠি আছে গো?’’
--‘‘না’’।
বাবার হঠাৎ বদলির জন্য নতুন জায়গায় নতুন বাড়িতে এসে উঠেছে ওরা। জন্ম থেকে পনেরটা বছর কাটিয়ে এসেছে যে অত পরিচিত খুব প্রিয় জায়গাটায় সেটা ছেড়ে আসতে কারো কি মন চায়! প্রতিবেশী পরিচিতজনেরা তো আসার দিনে গঙ্গা- যমুনা বইয়ে ছিল। যাহোক অজিত আসলে অয়নের চিঠির অপেক্ষাতেই অধীর হয়ে আছে। অয়ন ছিল অজিতের ওই যাকে বলে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ সেটাই। প্রথম প্রথম বন্ধু অয়নের অনেক চিঠি আসত। তবে ইদানিং বেশ ভাঁটা পড়েছে। হয়ত পড়াশোনার চাপ বেড়েছে, ক্রিকেটে আরও ভাল পরিচর্যা করছে, কিন্তু অজিত এই একটা ‘‘কিন্তু’’ থেকে কিছুতেই বেরুতে পারছে না। ভাবলেই থেকে থেকে বুকটা মুচড়ে উঠছে। ওর মূল্য কি ধীরে ধীরে কমে আসছে অয়নের জীবনে। অন্য বন্ধুদের সাথে ভাল আছে। ওর অভাব কাঁটার মত বিঁধছে না হৃদয়ে?
গলার কাছটায় কষ্ট দলা পাকিয়ে জোর করে মনটাকে আটকে রাখতে চায়।
বহুদিন পেরিয়ে গেছে, সাত কি প্রায় আটমাস। খুব সামান্য সংবাদ আদান প্রদান চলেছে ওদের মধ্যে। তবে অজিতের অস্বস্তিভাব যেন আরও বেড়ে চলেছে কোথাও যেন একটা বাধো বাধো ঠেকে অয়নের সাথে, একটু যেন দূর হয়ে গেছে। আর এই দূরত্বটা অজিত স্বাভাবিক বলেও মেনে নিতে পারছে না। কখনও একলা জানলার ধারে বসে থাকতে থাকতে অজান্তেই ভিজে উঠেছে দুচোখ সেই পুরাণ স্মৃতির ঢেউ-এ তলিয়ে গেছে থেকে থেকেই। দুই শরীর এক আত্মা বলত সবাই। সত্যি বলতে খুব অভিমান হয় অয়নের ওপর, মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে অয়ন চিঠি না দিলে ও দেবে না।
মায়ের ডাকে টনক নড়ল ওর। এতক্ষণ তবে জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল।
পুজোর ছুটি আসছে মা অজিতকে ডেকে বললেন, ‘‘এবছর পুজোয় মামাবাড়ি যাওয়া হচেছ না।’’ অজিতের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল সজল নয়নে বলল, ‘‘কেন? পুজোতেও কি এখানেই পড়ে থাকবে?’’ মা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘এবছর মামাবাড়ির সবাই চেন্নাই যাচেছ ওই সময়ে ভাবলাম তবে পুরোন বাড়ি থেকেই ঘুরে আসা যাবে তখন।’’
সত্যি মা? অশ্রুসজল নয়নেই যেন আন¨ের একটা পরশ খেলে গেল। মুচকি হেসে মা চলে গেলেন ঘর থেকে। আবার ভাবনার অতলে তলিয়ে গেল অজিত। ওখানে গিয়ে আবার সবাইকে আগের মত পাবে তো?
বিশেষ করে অয়নকে! প্রতি বছর যার সঙ্গ ছাড়া ঘুরতে বেরত না সে এখন একটা চিঠিও দেয়নি আমন্ত্রণ জানিয়ে। অজিত কেঁদে ফেলল; হয়তা ওর ভাবনাটাই ঠিক। অয়ন ভালই আছে ওকে ছাড়াও।
(২)
আর কিছুদিন পরই পুজো, অয়ন টিউশন থেকে আসার পথে মাঠ দিয়ে ঘুরে আসবে ভাবল। প্যান্ডেল কতটা কমপ্লিট হল সেটাও দেখা হয়ে যাবে আর পোস্টমাস্টারকে জিজ্ঞেসও করা হবে চিঠির ব্যাপারে। তবে অয়নের ভাগ্যই খারাপ, পোস্টঅফিস বন্ধ! অগত্যা ঘুরে এল। প্যান্ডেল বেশ সু¨র করেছে, তবে মনটা তেমন খুশি হল না। প্রতিবছর টিউশন পথে ও আর অজিত আসত এই প্যান্ডেল বানানো দেখতে। এবছর খুব একা লাগছে নিজেকে। অজিতও নিজেকে নতুন জায়গায় মানিয়ে নিয়েছে মনে হয়। নিজে থেকে আর চিঠি দেয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির পথে সাইকেলটা ঘুরিয়ে চলল অয়ন। ও ঠিক করেছে অজিতের চিঠি না পেলে ও আর চিঠি দেবে না।
আজ সপ্তমী দোলা আনতে বেরোবে এবার অয়নরা, খুব মনে পড়ছে আজ অজিতকে। এই পুজোটা অয়নকে ভীষণরকম একা হয়ে কাটাতে হবে। চোখটা ঝাপসা হয়ে এলে অয়ন খুব কষ্টে সামলে নিল নিজেকে। দোলা আনতে এসেছে অনেকেই। বাজি ফাটাচেছ, হইহুল্লা করছে ছেলেরা। একা একমনে সরে আসে অয়ন। দোলার দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে, ‘‘মা ফিরিয়ে দাওনা সেই আমার পুরনো অজিতকে। খুব কষ্ট হয় ওকে ছাড়া। তুমি তো মা দুগ্গা, তুমিতো সবার মন ভালো করতে পারো। প্লিজ মা! প্লিজ...’’
হালুম করে কেউ পেছনে থেকে ঠেস দিল, বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকাল অয়ন।
‘‘অজিত!!’’ নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
দুই বন্ধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল একে অপরকে। সবাই ঘুরে দেখছে ওদের।
মনে মনে মা দুগ্গাকে ওরা দুজনেই ধন্যবাদ দিল। পুজো আর একা কাটাবে না। মা দুগ্গাও যেন পরম আন¨ে দোলায় চেপে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে চললেন।
আর এদিকে?
এদিকে দুই পরম বন্ধুর চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে সবেগে অশ্রুধারা। সেই পবিত্র ধারা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচেছ এতদিনের জমান যত মান-অভিমান কষ্ট সব। হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে যাচেছ অদ্ভুত এক প্রাপ্তির আনন্দে।