ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
বিবার। ছুটির দিন। কিন্তু ছুটি আর ছেলেপুলেদের কোথায়? মা-বাপের বকুনি শোনার ভয়ে সন্ধ্যাবেলায় বৈঠকখানায় বসে পড়াশোনা করছিল সকলে। আর বারবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল, কখন আটটা বাজবে তার অপেক্ষায়। সাড়ে সাতটা নাগাদ যতীন দাদু ফিরলেন কলকাতা থেকে। তখন যেন সবাই দেহে প্রাণ ফিরে পেল। যতীন দাদুকে দেখে হাসিখুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল নাতি-নাতনির মুখ। যতীনদাদু হলেন তাদের ত্রাণকর্তা। নিরাপদ আশ্রয়। বটবৃক্ষ। বাবা, মা, কাকা, কাকিমা সেখানে ফেল।
এমন সময় বাড়ির গলি পথ ধরে কয়েকজন লোক সমস্বরে চিৎকার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচিছল। তারা বলছিল--লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। আওয়াজ শুনে সকলে বুঝতে পারল ভোট প্রচারে বার হয়েছে প্রতিবেশী লোকজনেরা।
শ্বশুর মশাইয়ের আগমন বুঝতে পেরে সন্ধ্যার মা এক বাটি মুড়ি চানাচুর ও চা বানিয়ে নিয়ে এল। যতীন দাদু হাত-পা ধুয়ে এসে পৌঁছলেন নাতি- নাতনিদের সেই আসরে। সবাই মিলে তখন চা মুড়ি খেতে শুরু করল। ঠিক সেই সময় ধ্রুব বলল— দাদু! কাকুরা সন্ধ্যাবেলায় কার সঙ্গে লড়াই করতে যাচেছ?
ধ্রুবর কথা শুনে ঠোঁটের ফাঁকে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল যতীন দাদুর। তিনি চায়ের পেয়ালায় গভীর একটা চুমুক দিয়ে বললেন--আজ আমি তোমাদের একটা গল্প শোনাব। গল্পটা আফ্রিকা দেশের লোককথা। গল্প শুনে তোমরা বুঝতে পারবে, লড়াইটা আসলে কার সঙ্গে?
দাদুর কথা শুনে নাতি-নাতনিদের মুখে একটা মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ছড়ানো ছিটানো বইপত্রর সবকিছু ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে গাল হাঁ করে বসে পড়ল দাদুর সামনে।
চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে যতীন দাদু শুরু করলেন গল্প বলতে।
সে অনেক বছর আগের কথা। সে সময় আফ্রিকা দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করত এক গোয়ালা। তার খামারে ছিল অসংখ্য গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া দুম্বা ইত্যাদি। দুধ, মাখন বেচে সে তার জীবিকা নির্বাহ করত। সংসার চালাত। অবিক্রীত দুধ জাল দিয়ে ‘সর’ বানিয়ে, ‘ঘি’ বানিয়ে বাজারে বিক্রি করত।
একদিন দুটো ব্যাঙ গোয়ালার অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে খোলা দরজা পেয়ে ঢুকে পড়ল ভাঁড়ার ঘরে। কিছু টের না পেয়ে ভাঁড়ার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল গোয়ালা। আর তাতেই খুব বিপদে পড়ে গেল ব্যাঙ দুটো। তারা কোন মতেই বার হতে পারল না ভাঁড়ার ঘর থেকে। তবুও বাইরে বার হবার জন্য তারা নানা ভাবে চেষ্টা করতে থাকল। আর চেষ্টা করতে গিয়েই তারা পড়ে গেল এক মহাবিপদে। ব্যাঙ দুটো পড়বি তো পড় একেবারে ‘সরের’ হাঁড়িতে পড়ে গেল। আর বার হবার কোন রাস্তা খুঁজে পেল না সেখান থেকে। হাঁড়ির ভিতরে সরের মধ্যে সাঁতার কেটে কেটে ঘুরে মরছিল তারা।
একসময় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে স্ত্রী ব্যাঙটা বলল— এখানেই বোধহয় আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে! আমি আর পারছি না। মুক্তি পাবার কোন আশা দেখছি না।
এইসব কথা ভেবে সাঁতার কাটা ছেড়ে স্ত্রী ব্যাঙটা সরের মধ্যে ভাসতে থাকল। একসময় সরের মধ্যেই সে ডুবে মারা গেল।
কিন্তু পুরুষ ব্যাঙটা সাঁতার কাটতেই থাকল। আর সাঁতার কাটতে গেলে তো পা চালাতে হয়, ব্যাঙ সেটাই করছিল। আর দুধের সরে বারবার আঘাতের ফলে সর ক্রমশঃ মাখনের দলায় পরিণত হচিছল। একসময় ব্যাঙ সেই মাখনের দলাতে উঠে হাঁড়ির বাইরে চলে এল। সে বেঁচে গেল।
সন্ধ্যা বলল— এতে কী হল দাদু?
এই লড়াইটা না করলে পুরুষ ব্যাঙটাও বেঁচে ফিরে আসত না। আসলে ব্যাঙের মতো মানুষের জীবনটাও সংগ্রামের উপর নির্ভর করে। লড়াই করে বাঁচতে হয়। এই পৃথিবীতে বাঁচতে হলে সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে। সংগ্রাম-ই হল আমাদের জীবন।