ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
কাল সাড়ে আটটার মধ্যে অজয়ের পড়া তৈরি হয়ে যায়। অজয় পড়ার টেবিলে তার বই-খাতা গুছিয়ে রাখে। সে কুসুমপুর হাই ßুñলে ক্লাস এইটে পড়ে।
বীণাপাণিকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখে অজয় জিজ্ঞাসা করে, ঠাম্মা! জলখাবারের তরকারি রান্না হয়ে গেছে?
—হ্যাঁ, দাদুভাই।
—আমি মুড়ি-তরকারি নিয়ে খামারবাড়িতে যাব।
—তোর ßুñলের পড়া তৈরি হয়ে গেছে?
—হ্যাঁ, ঠাম্মা!
বলতে বলতে অজয় বীণাপাণির কাছে আসে।
—সত্যি কথা বলছিস তো?
—তোমরাই তো শিখিয়েছ যে, সৎ পথে চললেই জীবনে উন্নতি করা যায়। সত্যি কথা বললে যথার্থ মানুষ হওয়া যায়।
—সত্যিই তাই। তোর ঠাকুরদা সৎ পথে থেকেই অর্থ-সম্পত্তি করেছে। তোর বাবা-মাও সৎ পথে জীবনযাপন করছে।
বীণাপাণির গলা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে অজয় বলে, ঠাম্মা! আমি কখনও মিথ্যা কথা বলি না। আমি কারও সঙ্গে অসৎ আচরণ করি না।
বীণাপাণি ডান হাতে তিন বার অজয়ের চিবুক স্পর্শ করে চুমু খায়; বলে, জানি দাদুভাই! তুই সমাজে বাপ-ঠাকুরদার সম্মান বজায় রাখবি।
মুড়ির কৌটো আর তরকারির কৌটো একটা ব্যাগে নিয়ে অজয় তাদের খামারবাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।
কুসুমপুরের পাড়ার মধ্যেই অজয়দের ছ-বিঘা জায়গায় খামারবাড়ি। খামারবাড়ি পাঁচ ফুট উঁচু ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। খামারবাড়িতে এক বিঘা ক্ষেত্রফলের দু’খানা পুকুর। পুকুরে রুই, মৃগেল, কাতলা, বাটা, সিলভার কার্প, পাঙ্গাশ, মাগুর, ভেটকি, চিতল, শোল, কই, পুঁটি, মৌরলা, পাঁকাল, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছ চাষ হয়। চারবিঘা ডাঙার চারিদিকে নারিকেল গাছ বেশি। তাছাড়া আম, সবেদা, লিচু, পেয়ারা, জামরুল, আতা ইত্যাদি ফলের কিছু গাছ। সারা বছর সব রকমের শাকসবজির চাষ হয়। গোয়াল আছে। গোয়ালে চারটে ভালো জাতের দুধেল গাই। প্রতিদিন কুড়ি-পঁচিশ লিটার দুধ বিক্রি হয়।
অজয়দের বাড়ি থেকে খামারের দূরত্ব আধ কিলোমিটার। পাড়ার পাবলিক রাস্তা সিমেন্ট-ঢালাই। রাস্তার ধারে এক প্রতিবেশী অজামিল সেনাপতির বাড়ি। অজামিল খুব কর্মবিমুখ লোক। তার স্ত্রী মলিনা, ছেলের বৌ রুমা একটা মুড়ি কারখানায় কাজ করে। তার ছেলে পলাশ একটা মুদিখানার কর্মী।
অজামিল ঘুরে বেড়িয়ে খায়। সে প্রতিবেশীদের কাছে বলে, পরিবারের কেউ আমাকে ভালো চোখে দেখে না। খাতির করে খেতে দেয় না।
মলিনা আর রুমা দুপুরে বাড়ি ফিরে ভাত-তরকারি রান্না করে। বাড়িতে যা রান্না হয়, অজামিলকে তা খেতে দেওয়া হয়।
অজামিল তাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় উবু হয়ে বসে আছে, রাস্তার লোকজনদের দেখছে।
অজয় কাছে আসতে অজামিল গদগদ স্বরে জিজ্ঞাসা করে, দাদুভাই! খামারে জলখাবার নিয়ে যাচিছস?
—হ্যাঁ।
—আমাকে দু-মুঠো মুড়ি আর একটু তরকারি দে না ভাই! বড্ড খিদে পেয়েছে!
—সকাল থেকে তুমি কী কাজ করেছ যে, তোমার খিদে পেয়ে গেছে।
অজামিল কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পায় না। সে নিঃশব্দে অজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অজয় বলে, আমরা সকলে কাজ করে খাই। তোমাদের বাড়ির অন্য সকলে তো কাজে গেছে। তুমি চুপচাপ ঘরে বসে আছো।
এক বয়স্কা প্রতিবেশিনী আলোছায়া মান্না চোখের ইশারায় অজয়কে উৎসাহিত করে।
আলোছায়াকে দেখে একটা ঢোক গিলে অজামিল বলে, আমি তো কাজ করতে চাই। আমাকে কেউ কাজে নিতে চায় না।
অজয় বলে, আমাদের খামারে কিছু কাজ করবে এসো। তোমাকে মুড়ি-তরকারি খেতে দেব।
অনিচছা সত্ত্বেও অজামিল উঠে দাঁড়ায়। অজয়ের পিছনে পিছনে হেঁটে সে খামারবাড়িতে আসে।
খামারে অজয়ের ঠাকুরদা সুধন্য হাজরা আর বাবা কাশীনাথ মেশিনে ধান ঝাড়াইয়ের কাজ করছে। অজয়ের মা আলপনা গোয়ালে কাজ করছে।
ধান ঝাড়তে ঝাড়তে সুধন্য কৌতুক করতে অজামিলকে বলে, কে? অজামিলবাবু যে!
অজামিল বোকর মতো একটু হাসে; বলে, খামারে কাজ করার জন্য অজয় আমাকে ডেকে নিয়ে এলো।
খামারবাড়ির ঘরে জলখাবারের ব্যাগ রেখে অজয় অজামিলের কাছে আসে।
সুধন্য অজামিলকে বলে, খড়ের তড়পা বাঁধো!
অজয় অজামিলকে জিজ্ঞাসা করে, দাদু! ক-আঁটি খড়ে এক তড়পা হবে?
অজামিল সোৎসাহে বলে, খড়ের হিসাব আমি ভালো জানি। কুড়ি আঁটি খড়ে এক তড়পা। চার তড়পায় এক পণ। ষোল পণে এক কাহন।
অজামিলকে খড়ের তড়পা-বাঁধা দেখিয়ে দিয়ে অজয় গোয়ালে আসে। ‘মা-মা’ বলতে বলতে সে দু হাতে আলপনাকে জড়িয়ে ধরে।
আলপনা বলে, আমি গোয়াল পরিষ্কার করছি। আমার হাত-পা নোংরা হয়ে আছে।
অজয় আদুরে গলায় বলে, থাক নোংরা! তবু তুমি আমার মা।
আলপনা হাসতে হাসতে অজয়ের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে; জানতে চায়, তোর ক্লাসের পড়া হয়ে গেছে?
—হ্যাঁ।
—তোর ঠাকুরমা কী করছে?
—ঠাম্মা কুটনো কাটতে বসেছে।
মায়ের একটু আদর মেখে অজয় খামারে আসে। সে অজামিলের সঙ্গে খড়ের তড়পা বাঁধে। তড়পা গুলো মাথায় করে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে গাদা দেয়।
বেলা সাড়ে ন’টার সময় সকলে পুকুরঘাটে হাত- পা ধোয়। খামারবাড়ির দালানে বসে মুড়ি-তরকারির জলখাবার খায়।
জলখাবার খাওয়ার পর অজামিল কাশীনাথের সঙ্গে ধান ঝাড়াইয়ের কাজ করে। দুপুরে বাড়ি গিয়ে, সে স্নান করে সুধন্যদের বাড়িতে আসে, ভাত খায়।
বীণাপাণি আর আলপনা খুব যত্ন করে অজামিলকে খেতে দেয়। অজামিল খুব তৃপ্তিতে আহার করে। সে প্রতিদিনই সুধন্যদের খামারবাড়িতে কাজ করতে থাকে।
কুসুমপুর মৌজাতেই সুধন্যদের আট বিঘা শালি জমি। আট বিঘা জমিতেই প্রতি বছর আমন ধান চাষ হয়। শীতকালে চার বিঘা জমিতে বোরোধান চাষ হয়। অন্য চার বিঘা জমিতে মুগ, খেসারি, মটর কলাইয়ের চাষ হয়।
সুধন্যদের পরিবারের সকলের কথাবার্তা, ব্যবহার খুব ভালো। পরিবারের সকলেই অজামিলকে খেত- খামারের সব কাজ শিখিয়ে দেয়। অজামিল নিজের আগ্রহে গোয়ালেও কাজ করে।
অজামিল যেমন পারে, তেমন কাজ করে। সুধন্যদের বাড়ির সকলে তা মেনে নেয়। তার কোনও কাজে কেউ অসন্তুষ্ট হয় না। সুধন্যদের বাড়িতে সে সকালে চা-বিßুñট, বেলা সাড়ে ন’টায় মুড়ি-তরকারি, দুপুরে ভাত খায়। বিকালেও সে খামারে কাজ করে। সন্ধেয় চা-বিßুñট খেয়ে বাড়ি ফেরে।
সুধন্য অজামিলকে মাসে পাঁচশো টাকা মজুরি দেয়। শুধু অজামিল নয়, তাদের বাড়ির সকলে খুব খুশি হয়।
মলিনা অজামিলকে বলে, সুধন্যদাদের খামারবাড়ির কাজে লেগে থাক। ভালোম¨ খেতে পাবে।
পলাশ বলে, পাড়ার অন্য কোনও প্রতিবেশী তোমাকে কোনও কাজে নেবে না। সুধন্যজেঠু বিবেচনা করে যে মজুরি দিচেছ, খারাপ নয়।
রুমা বলে, ঘরে বসে অন্ন ধ্বংস করার চেয়ে, কাজ করে খাওয়া অনেক সম্মানের।
অজামিল অলস হয়ে ঘুরে-বেড়িয়ে সময় কাটাতো। তাই রুমা মাঝে মাঝে অসন্তোষ প্রকাশ করত। ডালভাত, শাকভাত খেতে দিত। এক একদিন ভাত খেয়ে অজামিলের পেট ভরতো না। সে মলিনা বা রুমার কাছে ভাত চাইতে সাহস পেতনা। পাড়ায় ঘুরে প্রতিবেশিনীদের কাছে খাবার চেয়ে খেত। বাজারে ঘুরে দোকানদারদের ফেলে দেওয়া খাবার কুড়িয়ে খেত।
সুধন্যদের বাড়িতে বীণাপাণি আর আলপনা দু’জনেই ভালো রান্না করে। মাছ, ডিম, মাংস রান্না হয়। অজামিল সুধন্যদের বাড়িতে প্রতিদিন খুব তৃপ্তিতে আহার করে। তিন মাসের মধ্যে তার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।
অজামিল বীণাপাণিকে বলে, বৌদি! তুমি মা অন্নপূর্ণার মতো! তোমার হাতের রান্না খেয়ে আমার স্বাস্থ্য ফিরে গেছে। কাজ করতে খুব বল পাই।
বীণাপাণি নিঃশব্দে একটু হাসে।
অজয় জানতে চায়, আমাদের খেত-খামারে, বাগানে কাজ করতে তোমার ভালো লাগে?
অজামিল সোৎসাহে বলে, খুব ভালো লাগে দাদুভাই।
—আমার ঠাকুরদা বলে, আমার বাবা বলে আর আমিও বলি, আমাদের কাছে কর্মই জীবন, কর্মই ধর্ম।
দু-দিন ধরে ভেবে অজামিল অজয়ের কথার অর্থ উপলব্ধি করে; অজয়কে বলে, দাদুভাই! তুমি ঠিক কথাই বলো। কর্মই জীবন, কর্মই ধর্ম।
—দাদু! এই কথাগুলো মাঝে মাঝে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করবে।
—করব দাদুভাই। তুমি আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছ। তোমার কথা শুনে চললে, জীবনে ভালো ছাড়া ম¨ হবে না।
—শুধু আমার কথা শুনলে হবে না; নিজের বুদ্ধিতেও চলতে হবে।
—হ্যাঁ দাদুভাই! নিজের বুদ্ধিমতোও কাজ করি।
—তোমার দাদু বিবেচনা করে যে মাইনে দেবে, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি পাঁচজন প্রতিবেশীর কাছে তোমার কথা বলাবলি করি।
—খুব নি¨া করো তো?
—না দাদুভাই! তোমার প্রশংসা ছাড়া কখনও নি¨া করি না।
তাদের কথার মাঝে আলপনা আসে।
অজয় অজামিলকে জিজ্ঞাসা করে, আমার মা ভালো নয়?
খুশিতে উচছ্বসিত হয়ে অজামিল বলে, তোমার মা আমারও মা। মা আমার বড় মমতাময়ী! মা মমতাময়ী, তাই তোমার মনেও অনেক মমতা।
ভাবাবেগে অজয় দু-হাতে আলপনাকে জড়িয়ে ধরে। অজামিল অপলকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে; আন¨ে আপ্লুত হয়ে ওঠে।