ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
কেবলমাত্র ১৬ বছর পর্যন্ত গ্রাহক-গ্রাহিকা ও পাঠক-পাঠিকাদের জন্য
১৯৭৪ সালের ১৩ বছরের কিশোরী তানিয়া কাঞ্জিলাল আজ অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদাসীন সরকারী কর্ত্রী, সফল দুই সন্তানের জননী এবং যশস্বী বাচিক শিল্পী তানিয়া কাঞ্জিলাল দত্ত, কলকাতা নিবাসী। তার সাফল্যে আমরা গর্বিত। সম্পাদক, ছোঃ কঃ
প্রিয় বর্ণালী,
‘তোমার চিঠি পেলাম। তুমি জানতে চেয়েছো আমি কি ভাবে এই গ্রামকে এত ভালোবেসে ফেললাম, আর গ্রামের কোন জিনিসকে আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসি তার বর্ণনা। তাহলে প্রথম থেকেই শোন।
প্রায় চার বছর আগে আমি একদিন বারা¨ায় বসে আছি এমন সময় ছোটমামা এসে বললেন, ‘‘জানিস কুলু তোরা অনেক দূরে একটা নির্জন গ্রামে চলে যাবি।’’ আমি ছোটবেলা থেকেই নির্জনতা ভীষণ পছ¨ করতাম। বইতে পড়া গ্রামের বর্ণনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘‘সত্যি মামা!’’ কলকাতার এই হৈ হট্টোগোল, গোলমাল থেকে মুক্ত হয়ে নির্জন এক গ্রামে চলে যাব শুনে আমার তখন সে কী আন¨! মনের মধ্যে গ্রামের কত রকম ছবি আঁকতে শুরু করলাম। কিন্তু তখন কল্পনায়ও আনতে পারি নি যে আর এক মাসের মধ্যেই আমরা এই নির্জন গ্রামে এসে পড়বো।
আমাদের গ্রাম চব্বিশ পরগণা জেলার একেবারে দক্ষিণ দিকে। গ্রামের পাশ দিয়ে ছল-ছলাৎ করে বয়ে চলেছে বিদ্যা নদী। বিদ্যার অপর পারে বেশ ঘন একটা বন। তবে সেটা সু¨র বন নয়। সু¨রবন আমাদের এখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। বাংলাদেশ আমাদের গ্রাম থেকে খুব কাছে। গ্রামে অনেক জিনিস নেই। যেমন--ট্রেন নেই, বাস নেই, ট্রাম নেই, রিক্সা নেই, পাকা রাস্তা নেই, ইলেকট্রিক লাইট পর্যন্ত নেই। কিন্তু আছে তার থেকে অনেক বেশী। বিদ্যা নদী আছে, সু¨র বন আছে, ধানের ক্ষেত আছে, নদীতে ছোট ছোট নৌকা চড়ে ঘুরে বেড়াবার আন¨ আছে, সূর্যমুখী ফুলের ক্ষেত আছে, পদ্মপুকুর আছে আর আছে ফুলের মতো নিষ্পাপ, সরল, সাদাসিধে সাতশ অধিবাসী। কিন্তু প্রথমে গ্রামে যে সব জিনিস নেই তার অভাব-টাই আমি বেশী অনুভব করতাম। ভীষণ একা একা লাগতো। চুপচাপ মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকতাম। একদম ভালো না লাগা সন্ধ্যায় পড়ার ঘরে একটা বই সামনে খুলে চুপচাপ বসেছিলাম। এমন সময় ভীষণ ঝড় এল। ঝড়ের সঙ্গে সমান তালে পড়তে লাগলো বৃষ্টি। সে কী প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি। আমি টেবিল থেকে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝড়ের প্রচন্ড ঝাপ্টায় বাড়ির পাশের সাঁই বাবলা গাছটা একবার ডালপালা সুদ্ধু মাটির মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচেছ আবার কোন রকমে উঠে দাঁড়াচেছ, আবার পড়ছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, তার মধ্য থেকে চাঁদামামা তার হাসি হাসি মুখখানি একবার বার করেই আবার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছেন। পাশে দীঘিটার জল বাতাসে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বিরাট বিরাট ঢেউগুলো একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে নিজেরাই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচেছ। জলের উপর ঘন কলমীশাকের দামটা ঢেউয়ের তালে তালে বার বার নেচে নেচে দুলে দুলে উঠছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো ঢেউগুলোর উপরে পড়ছে, মনে হচেছ লক্ষ লক্ষ প্রদীপ যেন কতদূর ভেসে ভেসে এসে নাচতে নাচতে কোন সুদূরে অদৃশ্য হয়ে যাচেছ। সব কিছুর উপরে হীরের টুকরোর মতো বৃষ্টির টুকরো গুলো ছড়িয়ে পড়ছে। আমি একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম ঝড়ের রাতে গ্রামের এই সৌ¨র্য দেখে। কতক্ষণ ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। ধমকে, হঠাৎ চমকে উঠে চোখ মেলে দেখি মা ব্যস্ত ভাবে সেল্ফের বই গুলো সরাচেছন। আমি বললাম, ‘‘কি হয়েছে মা?’’ মা রেগে উঠলেন। বললেন, ‘‘হবে আবার কি? চোখ বুজে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছিস আর এদিকে বৃষ্টির ছাঁট এসে সেলফের সমস্ত বই ভিজিয়ে দিয়েছে।’’ ছোট ভাইটা কেঁদে ওঠাতে মা আবার অন্য ঘরে ছুটলেন। আমার হঠাৎ খেয়াল হলো যে, বৃষ্টির জলে আমার ফ্রকটাও ভিজে চুপচুপে হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রকটা ছেড়ে নিলাম।
এই দিন কি হয়েছিল জানি না। তবে এই দিন থেকেই আমার চোখের সামনে গ্রামের এক নতুন রূপ খুলে গেল। তারপর দিন থেকেই যত ছোট্ট জিনিসই দেখতাম তার ভেতরের সৌ¨র্যকে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা আমার যেন এক নেশার মতো হয়ে গেল। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের গ্রামে যত জিনিস নেই তার চেয়ে অনেক বেশী সু¨র জিনিস প্রচুর আছে। এই দিন থেকেই আমি আমার গ্রামকে ভীষণ ভালোবেসে ফেললাম। এখন আমি এই গ্রাম ছেড়ে বেশী দিন থাকতে পারি না। শহরে গেলে যেখানকার ভিড়, গোলমালের মধ্যে গ্রামের শান্ত পরিবেশকে আমার বড় বেশী মনে পড়ে।
গ্রামের সব জিনিসই আমার ভালো লাগে। তবে সবচেয়ে ভালো লাগে সূর্যমুখী ক্ষেত, নদী আর পদ্মপুকুরকে। প্রথমটার কথাই প্রথমে বলি।
আমাদের গ্রামে কয়েক বছর ধরে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হচেছ। ধানক্ষেত থেকে ধান কেটে নেওয়ার পর চাষীরা গ্রামের সব জায়গায় সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে। পৌষ মাসে বিরাট বিরাট মৌচাকের মতো ফুলে গ্রামের প্রায় সব জায়গা ভরা থাকে। গ্রামের রূপটা হয় তখন ঠিক এই রকম--প্রায় সব জায়গায় হলুদ হলুদ সূর্যমুখী ফুলে ভরা, মাঝে মাঝে কয়েকটা ছোট ছোট পুকুর, একটা বড় দীঘি, কতগুলো বড় বড় গাছ। সাপের মতো এঁকেবেঁকে গ্রামের ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা মাটির রাস্তা। একটা বড়ো খেলার মাঠ। আর অনেকগুলো ছোট, ছোট, নীচু, নীচু, মাটির বাড়ি। গ্রামটাকে ঘিরে বয়ে চলেছে বিদ্যা নদী। কি সু¨র দৃশ্য তাই না? আম সূর্যমুখী গাছ গুলোর মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে গেছি। হঠাৎ খেয়াল হলো একদম সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বেশী দেরী হলে মা’র কাছে আবার বকুনি খেতে হবে, তাই দু’হাত দিয়ে গাছগুলোকে সরিয়ে সরিয়ে ছুটে ছুটে কোন রকমে অন্ধকার নামার আগে বাড়ি ফিরে এলাম। তখন আমি ভীষণ হাঁপাচিছ, মা তো অবাক! ‘‘কি রে এরকম ঘামিয়ে হাঁপিয়ে কোথা থেকে এলি?’’ মা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি কোন কথা না বলে বারা¨ার উপর বসে হাঁপাতে লাগলাম। খানিকক্ষণ পর মা আমার মুখের দিকে তাকিয়েই হাসতে শুরু করলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে কাকু আর পাশের বাড়ির মাসীমাও শুরু করলেন হাসি। আমি তো অবাক, এরা এত হাসছে কেন! ছুটে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি আমার মুখে, চুলে, কানে, নাকে, হাতে এককথায় সর্বাঙ্গে সূর্যমুখী ফুলের রেণু লেগে রয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি রেণগুলো মুছতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না, কেন? কি জানি!!
যখন তেল করবার জন্য জন্য চাষীরা ফুলগুলোকে তুলে নেয়, তখন খালি ক্ষেতগুলোর দিকে তাকালে আমার ভীষণ কান্না পায়। কিন্তু নদীর তীর যেন আরও সু¨র নিত্য নতুন। পরের চিঠিতে নদীর কথা লিখব কেমন? এই যাঃ গ্রামের নামটাই লিখি নি। যাক্ আমার নিজের ভাষাতেই শুনে নাও—
‘‘বিদ্যা নদীর ধারে
ঐ যে আমার গ্রাম
সোঁদর বনের পাশে
‘রাঙ্গাবেলিয়া’ নাম।’’
পরের চিঠিতে গ্রামের আরও অনেক কথা লিখব। প্রীতি নিও। —তনিমা
ছোটদের কথা, শারদ সংখ্যা, দ্বিতীয় বর্ষ, ১১-১২শ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭৪ থেকে পুনর্মুদ্রিত।