ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
ক্লাস এইটের দীপ্তজিৎ এর স্কুলের হোমটাস্কের সাহায্যের জন্য তার বাবা একজন টিউশন স্যার দিয়েছেন। পাড়ার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট পাড়ার রতনকাকু। আবার সেই রতনকাকু তার খাতায় হোমটাস্ক দিলে তা সমাধান করেছেন দীপ্তর দাদু, পঁয়ষট্টির পরিতোষবাবু। হ্যাঁ, দীপ্তর দাদু পরিতোষবাবু বলতে নেই এখনো দিব্যি শক্ত সমর্থ্য মানুষ। দিব্যি বাড়ির টুকটাক কাজ, যেমন বৌমার জন্য হাট বাজার, নিজের গিন্নির জন্য আলুটা মূলোটা এনে দেওয়া, নাতি-নাতনিদেরকে একটু পড়ানো দিব্যি পারেন এই বাঙালি প্রবীণ মানুষটি। হ্যাঁ, বাঙালিবাবু এজন্য যে পরিতোষবাবু এখনো সাদা ফুলশার্ট জামার সঙ্গে সাদা ধুতি পরেন। বাজার গেলে থলির বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায় পালং শাকের শিস। ফুলকপি কিনলে দড়ি বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে আনেন। নাতি দীপ্ত দাদুর কাছে পড়ে খুব খুশি। কারণ দাদু যেন googlত্র! হ্যাঁ, দাদু সবকিছুই জানেন, না জানলেও পড়াশোনা করে তারপর বুঝিয়ে দেন। দাদু কোনো পড়া একবার বোঝালে তা আর ভোলা যায় না। মনে থাকেই থাকে।
দাদু নানারকম বাস্তব উদাহরণ, গল্পগুজবের মাধ্যমে কোন বিষয়ে এমনভাবে আলোচনা করেন যে, তা একেবারে যাকে বলে হৃদয়ঙ্গম হয়ে যায়। কিন্তু বোঝা যাচেছ, দাদুর বেশ মন খারাপ। কেন? বলা যেতে পারে, তেমন কোনো কারণ নেই! তবে কি স্রেফ বিনা কারণেই মন খারাপ? না, তাও নয়। তবে কী? ব্যাপার হলো, আমাদের দাদু জানেন যে, এ বছর কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মশতবার্ষিকী। এ বিষয়ে তিনি দু-একদিন দীপ্তর সামনে আলোচনাও করেছেন, আর ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত বাংলা বইগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে খুঁজে দেখেছেন সুকান্তের কোন কবিতা কোন ক্লাসের পাঠ্য বইয়ে আছে কিনা। উঁহু! উনি সব উল্টেপাল্টে দেখে বেশ হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। পরে পরে আলোচনায় দীপ্ত বুঝেছে, দাদুর প্রিয় সুকান্তের কবিতাগুলি আজকালকার প্রায় কোনো পাঠ্য বইয়েই নেই। দাদুর প্রিয় সুকান্তের কবিতা-- ‘রানার’, ‘একটি মোরগের কাহিনী’, ‘ছাড়পত্র’, ‘পুরনো ধাঁধা’, ‘প্রিয়তমাসু’, ‘ভালো খাবার’ ইত্যাদি।
ঠিক পরদিনই মুশকিল আসান করলো কুচি। হ্যাঁ কুচি। কুচি হলো দীপ্তদের পাশের বাড়ির চিন্ময় কাকু আর কুহু কাকিমার দশ বছরের মেয়ে। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। চিন্ময়কাকু দাদুকে কাকু বলে। একদিন বাড়ি এসে বললো পরিকাকু, তুমি তো দীপ্তকে পড়াও, ওদের সঙ্গে আমার মেয়েটাও এসে বসবে, একটু দেখিয়ে দিও। দাদু বললেন, পাঠিয়ে দিস। আমার পড়ানো তো তোর পেশাদার টিউশন মাস্টারদের মত হয় না। গতানুগতিক নয়। যেদিন যেরকম সময় হয় ওরা বসে, আমাকে বসতে হয়। তবে এখন দুপুরে ßুñল তাই সকাল ৬টা থেকে বেলা নটা পর্যন্ত ওরা থাকে। আবার বিকেলে একটু ঘুমানোর পর বেলা তিনটা থেকে ছটা পর্যন্ত বসাই। দেখিস যদি তোর বিটি রাজি থাকে পাঠিয়ে দিস। আমার কোনো অসুবিধা নেই!
এখানে মনে রাখা দরকার যে, এই কুচি মেয়েটা সবারই খুব পছ¨ের কারণ, ও বুদ্ধিমতি, ছটফটে এবং মিশুকে। দাদু তো ওকে আরো বেশি ভালোবাসে, কারণ এই ‘কুচি’ নামটা ওনারই দেওয়া। যখন ওর নাম রাখার সেই সংকটকাল, তখন ঠিক হয় মা বাবার নামের অক্ষর দিয়েই মেয়ের নাম হবে। তখন চিন্ময় আর কুহুর নামের আদ্যক্ষর ‘কু’ আর ‘চি’ দিয়ে ‘চিকু’ হবে নাকি ‘কুচি’ তা নিয়ে ঘোর বিতর্কের সময় দাদু বললো, অবশ্যই ওর নাম হবে ‘কুচি’ কারণ এখন তো লেডিস ফার্স্ট। তাই কুহু কাকীর নাম আগে রেখে হয়ে গেল চিকু নয় কুচি। তো এই কুচিকে দাদু মাঝেমধ্যে ‘বিবিসি’ বলে। কারণ ও নাকি সংবাদের উৎস। গোটা গাঁয়ের এলাকার এমনকি দেশ-বিদেশের খবর দেওয়ার জ্যান্ত রেডিও। বাগদী পাড়ার কোন জেলে ৫ কেজি ওজনের বোয়াল পেয়েছে, কার্তিক ঘোষের বড় গাইটি সকালে ক’কেজি দুধ দেয়, অমল ধোপাকে দৈনিক কতগুলো কাপড় কাচতে হয়, যমুনার দহে এবার কেমন মাছ জমেছে, সব এই কুচির নখদর্পণে। তো এই কুচি তিন দিন আগে মামার বাড়ি গেছিল। গতকাল সে ফিরে এসেছে। দাদু তো তার মামার বাড়ির খোঁজ-খবর নিতে, তত্ত্ব তালাশ করতেই ব্যস্ত। ওদিকে কুচি গড় গড় করে বলতে থাকে দিদা দাদু মামা মামি মামাতো ভাই বোনদের খবর। শেষে বললো, জানো তো দাদু, মামাদের পাড়ায় ‘সুকান্ত সংঘ’ বলে একটা ক্লাব আছে।
দাদু বিস্মিত হয়ে বললেন, তাই নাকি?
--তো, সেখানে গত রবিবারে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মদিন পালন হলো। বসে আঁকো প্রতিযোগিতা হলো।
--তুই নাম দিয়েছিলিস?
--হ্যাঁ, তবে কিছু হতে পারি নাই। পরে অবশ্য একটা ভালো ছবি এঁকেছি। সেটা তোমার জন্য এনেছি, দেখবে? দাঁড়াও আনছি।
একটু পরে, যথারীতি একটা আর্টপেপারের আধখানা দুহাতে বুকের সমানে ধরে তার নিজের হাতে আঁকা ছবিটা সে নিয়েই এলো। দাদুর সামনে নামিয়ে দেখালো। দাদু অবাক হয়ে দেখলো পিঠে চিঠির বোঝা নিয়ে একজন মানুষ লণ্ঠন নিয়ে দৌড়াচেছ। ছবির নিচে কুচির হাতের চেনা লেখা ‘রানার রতন রায়’। কুচি বললো, জানো তো দাদু আমার মামার বাড়ির পাশের এই রতনকাকু রানার সেজে যা সু¨র নাচলো না। রানার গানটা মোবাইলে বাজিয়ে খুব সু¨র নেচে খুব হাততালি পেল। আমার মামাতো ভাই দীপের রং দিয়ে এঁকে ফেললাম, ইস, যদি এই ছবিটা ‘বসে আঁকো’তে আঁকতাম। ফার্স্ট হতাম।
--দাদু বললেন, তা আঁকিসনি কেন?
--কুচি বললো, না আঁকা তো সকালে হয়ে গেছিল। আর রতনমামুর নাচ হলো, রাত্রে। নাচ দেখেই তো মাথায় আইডিয়াটা এলো।
দাদু গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখেছিস! কেন আমি ‘রানার’ কবিতাটি খুঁজছিলাম। এটা দারুণ কবিতা রে। আমাদের ক্লাস এইটের বাংলা বইয়ে ছিল। হ্যাঁ, ‘রানার রানার রানার’। ‘রানার’ ছাড়া সুকান্ত হয় না। বাহঃ খুব ভালো হয়েছে।