ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
কতোদিন ভালো করে ঘুমোয়নি নুরু। ঘুম আসার কথাও নয়। সামনেই স্কুলে সেকেন্ড টার্মের পরীক্ষা। এই নম্বরগুলো এ্যানুয়ালের নম্বরের সাথে যোগ হয় কিনা! ওদিকে বুবুটাও উঠে পড়ে লেগেছে এবছর নুরুকে ডিঙিয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হবার জন্যে। ক্লাসের সব বই নুরুর নেই। তবুও সব ক্লাসের সব পড়া একদম ঠিক ঠাক বলে দিতে পারে।
একদিন বিজন স্যার নুরুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন —‘হ্যারে নুরু, লক্ষ্য করেছি তুই প্রতি বুধবারই স্কুলে আসিস না, কেন?’
নুরু মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে। স্যার আবার বললেন —‘কেন তুই কোনো বুধবারই স্কুলে আসিস না, উত্তর দে।’
নুরু শান্ত গলায় জবাব দেয় —‘স্যার, ওইদিনই আমি পাড়ায় যাই। আমার মা নানারকম শাক তুলে দেয়। আমি সেই শাক পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করি।’
বিজন স্যার নুরুর এই কথা শুনে বেশ বিরত হয়ে পড়লেন। নুরুর বাবা কয়েক বছর হলো গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। তখন থেকেই নুরুর মায়ের ওপর সংসারের সব দায়িত্ব। তখন নুরু বড্ড ছোটো ছিল। এখন একটু বড়ো হয়েছে। ক্লাস ফোরে পড়ে। বুধবার স্কুলে না আসার জন্যে স্যারেরা তাই কিছু বলে না। আগের বছরও ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে ও। ওর মেধা দেখে সব স্যারই ওকে একটু অন্যভাবে দেখে। যখন ক্লাস হয়, সব পড়া মন দিয়ে শোনে। সব প্রশ্নের উত্তর দেয় যথাযথ। স্কুলের পড়া তৈরি করার জন্যে অনেক রাত পর্যন্ত নুরু জেগে থাকে।
নুরুর মা খুব ভোরে ওঠে, বাড়ির কাজ সেরে নেয়। তারপর পাঁচটা বাড়িতে কাজ করে। নুরু সকালে মসজিদে যায়, নামাজের পাঠ নেয়। তারপর স্নান করে স্কুল চলে যায়। সকালে নাস্তা করে না প্রায়শই। একেবারে স্কুলে দুপুরের খাবার খায় পেটভর। নুরুর মা কোনো বাড়ি থেকে কিছু খাবার দাবার পেলে সেদিন সন্ধেবেলা ওদের খাওয়া হয়। খুব কষ্ট করে সংসার চালায় নুরুর মা, তবুও কারুর কাছে হাত পাতে না কখনো। নুরুর মা শুধু নুরুকে বলে —‘বাবা মানুষের মতো মানুষ হও। তাহলেই আমাদের কষ্টের দিন ঘুচবে।’
প্রতি বুধবার খুব ভোরে নুরুর মা ঢলদিঘির জলে নেমে বস্তা ভরে হিঙচে শাক, কুলেখাড়া, আর কলমি শাক তুলে আনে। সেগুলো আঁটি বেঁধে বেঁধে ব্যাগে ভরে দেয়। নুরু সকাল হলেই ব্যাগ নিয়ে পাড়ায় বেরিয়ে যায়। সেগুলো কেনার জন্য অনেক মানুষ মুখিয়ে থাকে। বিক্রি হয়ে যায় সব। সেগুলো বিক্রি করে যে কটা টাকা পায় তা দিয়ে চাল, ডাল, তেল, নুন, তরিতরকারি হয়ে যায় সপ্তাহভর। তার থেকেই মাঝে মাঝে খাতা-পেন কিনতে হয়। নুরুদের একটা পাড়া পরেই ওদের স্কুলের ওহিদ স্যারের বাড়ি। তিনি নুরুর কথা সব জানেন। এ্যাতো কষ্ট করেও ক্লাসে ভালো পড়াশোনা করে বলে ভালোও বাসেন নুরুকে।
সেকেন্ড টার্মের পরীক্ষা হতে আর সপ্তাহ দুয়েক বাকি। বুধবার পাড়ার থেকে বাড়ি ফেরার পথে নুরুর শরীরটা খুব খারাপ লাগে। বাড়ি ফিরে মেঝেতে চ্যাটাই বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। নুরুর মা লোকের বাড়ি কাজটাজ সেরে বাড়ি এসে দেখে নুরু ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। গায়ে মাথায় হাত ঠেকিয়ে দ্যাখে গা-টা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। সেই রাতেই ধুম জ্বর এলো নুরুর। সারা রাত মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কখন ভোর হয়ে যায় নুরুর মা টের পায়না। ভোরের দিকে জ্বরটা খানিক কম হলে নুরু ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন আর নুরুর মা কারুর বাড়িতে কাজে গেল না। জ্বরের জন্য ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গিয়ে পরপর তিনদিন নুরু স্কুলে যেতে পারল না।
ক্লাসে বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা হলো নুরুর অনুপস্থিতি নিয়ে। বিজন স্যার ক্লাসে নুরুকে দেখতে না পেয়ে অন্য ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলেন। কিন্তু কারুর কাছ থেকে সদুত্তর না পেয়ে ওদের ক্লাসেরই পিনুকে বললেন নুরুর খবর নিতে। ওদের বাড়িতে যেতে। পরীক্ষা শুরু হতে যে আর বেশি দেরি নেই। পিনু বলল —‘আচ্ছা স্যার, আমি আজ বাড়ি ফেরার পথে ওর বাড়িতে যাবো।’ পিনুর বাড়ি নুরুদের পাশের পাড়ায়। শনিবার দুপুরে বাড়ি যাওয়ার সময় পিনু নুরুদের বাড়িতে গেল। পিনুকে দেখে নুরু খুব আনন্দ পেল। বলল —‘বুধবার রাত থেকে খুব জ্বর রে। তাই এ কদিন স্কুলে যাওয়া হলো না। বাকি পড়াগুলো করা হলো না। হ্যারে, স্যারেরা আমার কথা কিছু বলছিলেন না কী!’
পিনু বলল —‘হ্যাঁ, বিজনস্যার তোর খবর নিতে বললেন।’
—‘সোমবার থেকে স্কুলে যাবো রে। পড়াগুলো বুঝে নিতেও হবে। পরের সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তিন-চারদিন বইমুখোই হতে পারিনি।’ নুরু বলল পিনুকে।
সোমবার থেকে নুরু ফের স্কুলে গেল। স্কুলে যেতেই ক্লাসের বন্ধুরা ওকে ঘিরে ধরল। সবকিছু জানলো ওর কাছে। বিজনস্যারও ক্লাসে এসে নুরুর সব খবর পেলেন। ক’দিনের বাকি পড়াগুলো বন্ধুদের কাছ থেকে বুঝে নিতে বললেন স্যার। মঙ্গলবার স্কুলে এসে নুরু খবর পেল ওহিদ স্যার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। স্কুলে আসতে পারছেন না। বুধবার নুরু শাকের ব্যাগ নিয়ে পাড়ায় গিয়ে একটা পাড়া টপকে ওহিদস্যারের বাড়িতে চলে গেল খবর নেওয়ার জন্য। স্যারের বয়েস হয়েছে, তার ওপর কী যেন একটা ভারী অসুখ হয়েছে শুনল গিয়ে। নুরু ব্যাগ থেকে দু’আঁটি কুলেখাড়া শাক স্যারের জন্যে দিয়ে বলল —‘এগুলো খাবেন স্যার। দেখবেন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন।’
ওরা নুরুকে শাকের দাম দিতে চাইলে নুরু তা নিল না।
দেখতে দেখতে স্কুলের সেকেন্ড টার্মের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। কিছুদিন পর শেষও হয়ে গেল যথারীতি। নুরুর পরীক্ষা হলো ভালোই। যেইদন পরীক্ষা শেষ হলো, সেদিন গোটা স্কুল জুড়ে কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। কোনো স্যারের মুখে কথা শোনা যাচ্ছে না কিছু। সব স্যারই আজ স্কুলে এসেছেন, শুধু ওহিদস্যার ছাড়া। দু’সপ্তাহের বেশি উনি স্কুলে আসতে পারেননি। নুরু গুটিগুটি পায়ে বিজনস্যারের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল ওহিদস্যার আসেন নি? বিজনস্যার ছলছল চোখে বললেন —‘উনি আর কোনোদিনই আসবেন না।’