ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
এক গ্রামে বাস করতেন এক দম্পতি। তাঁরা তাঁদের একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলেন অর্ণব। অর্ণব মানে সমুদ্র। তাঁরা ভেবেছিলেন একমাত্র ছেলে অগাধ বুদ্ধিসম্পন্ন হবে। সমুদ্রের যেমন তল পাওয়া যায় না, তার বুদ্ধিও হবে অফুরান। কিন্তু বিধি বাম। ও যখন কথা বলতে শিখল, বাবা-মা লক্ষ্য করলেন বুদ্ধিতেও একটু খাটো। যে যা বলতো তাইই বিশ্বাস করতো, যাচাই করার ক্ষমতা বিশেষ ছিল না। তাকে না বলা যায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, না বলা যায় স্বাভাবিক। সরল মনের অর্ণব দিনের পর দিন এমন বোকা বোকা কাজ করতে লাগলো যে ওর নামটাই বোকারাম হয়ে গেল। একবার হয়েছে কী, ওর মা ওকে চাল, ডাল, আনাজপাতি আনতে বাজারে পাঠিয়েছেন। বাড়ি ফিরে বাজারের ব্যাগ নামিয়ে মাকে সোৎসাহে বলতে লাগল—
‘তোমরা আমাকে বোকা বলো তো, দেখ আমার বুদ্ধি।’
মা-তো ব্যাগ থেকে আনাজ বের করতে গিয়ে দেখেন রুমালে বাঁধা একটা পুঁটুলি।
‘এতে কী?’ মা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ওতে উচ্ছে আছে। চালের সঙ্গে আনলে চালটা তেতো হয়ে যেত না।? এবার বলো আমার বুদ্ধি আছে কিনা?’ বলেই বিজ্ঞের মত তাকালো মায়ের দিকে।
‘দূর বোকা, তোর বুদ্ধি আর কবে হবে রে?’ হতাশ সুরে বললেন মা। ‘চালের সঙ্গে উচ্ছে আনলে আবার তেতো হয়?’
‘কেনো, তুমি যে সেদিন বললে ভাতে উচ্ছে দিলে ভাত তেতো হয়ে যায়!’
‘হায় আমার পোড়া কপাল! ভাত ফুটলে উচ্ছে থেকে তেতো বের হতে পারে, কিন্তু চালের সঙ্গে উচ্ছে আনলে তেতো হবে কেমন করে?’
আর একদিনের ঘটনা—
পাড়ার এক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেন বাবা-মা। কিন্তু বোকারাম কিছুতেই গেল না।
‘আমি বাড়ি পাহারা দেব’ —বলে জেদ ধরল সে।
‘ঘরদোর খোলা রেখে কোথাও যাস না যেন।’ মা বারবার করে সাবধান করে গেলেন।
হঠাৎ মনে হলো সবাইকে চমকে দেবে সে। কিছুক্ষণ পরেই নিমন্ত্রণ বাড়িতে গিয়ে হাজির। মা-বাবাতো হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। ‘বাড়ি আলগা রেখে চলে এলি?’ বোকারাম আঙুলের ডগায় একটা চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল— ‘ঘরে তালা দিয়ে এসেছি, তোমাদের কোন চিন্তা নেই।’ কিন্তু তাঁরা বাড়ি ফিরে দেখলেন ঘরের দরজা হাট করে খোলা। কেউ ভিতরে ঢুকে গোটা ঘর তছনছ করেছে! টেবিলে টিভিটাও নেই। মা কপাল চাপড়ে বললেন— ‘তুই কি চিরকালটা এমন বোকাহাবাই থাকবি?’ মা ভালো করে দরজার কাছে এসে দেখলেন বোকারাম তালাটা ঠিকই দিয়েছিল, কিন্তু হাঁসকলটা না টেনেই। অর্থাৎ তালা না দেওয়ারই সমান।
এমনি করে বারবার সে বুদ্ধির পরীক্ষা দিতে যায় আর ডাহা ফেল করে। দিন যায়, গায়ে গতরে বড় হয় বোকারাম। বাবা মারা গেছেন। মাও অসুস্থ। জমানো অর্থে আর কতদিন চলে। মা তাকে যতবার টাকা দিয়ে কোন ব্যবসাতে উৎসাহ দিয়েছেন বুদ্ধির অভাবে গো ঠকান ঠকে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরেছে সে। কেবলই ভাবে, ‘আমি কি কোনদিন একটা কাজের মতো কাজ করে সকলকে চমকে দিতে পারব না। মন খারাপ করে হাঁটতে হাঁটতে সে এক জনবহুল জায়গায় এসে পড়েছে।’ হঠাৎ দেখল একটা দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা— ‘এখানে পাখির দানা পাওয়া যায়।’ ব্যাস ঢুকে পড়ল দোকানে। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল— ‘আচ্ছা কাকু, পাখির দানা লাগালে পাখি হবে?’ দোকানদার প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন, তারপর ভাবলেন —একে নিয়ে তো খানিক মজা করা যাবে! বললেন —‘হ্যাঁ, হবে। তা তুমি কোন পাখির দানা চাও বলো।’
‘টিয়া পাখির।’
‘বেশ, এই নাও টিয়া পাখির দানা’ মুচকে মুচকে হাসতে থাকলেন দোকানদার।
‘আচ্ছা, দানা লাগাবার কতদিন পরে পাথ পাব?’
‘আগে লাগাও তো! গাছ হোক, ফুল হোক তবে না পাখি পাবে। এখনই যেন কাউকে বোলো না। তাহলে সবাই তোমার পাখি নিয়ে নেবে। আর দেখো, যেদিকটায় কেউ যায় না সে দিকটায় লাগিয়ে দিয়ে যত্ন করো কেমন!’
বোকারাম ঘাড় নেড়ে নাচতে নাচতে চলে এলো। বাড়ির পিছনের দিকটায় বন পরিস্কার করে মাটি কুপিয়ে দানা লাগিয়ে দিল। গাছ হলো কিন্তু পাখি তো হলো না। বোকারাম আবার দোকানদারের কাছে গেল। দোকানদার ওকে দেখেই জানতে চাইলেন— ‘কি ভাইপো, পাখি হলো?’
‘না কাকু, পাখি তো হল না!’
‘হবে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে খোকা।’ দোকানদার আরও কিছু দানা দিলেন। বললেন— ‘যাও এগুলো লাগিয়ে দাও।’
বোকারাম সেগুলোও এনে লাগিয়ে দিল। এমনি ক রে সে বারবার যায় আর দানা এনে লাগায়। পাখি আর হয় না। গাছগুলো কেবল বাগান জুড়ে সাঁতার কাটে। এবার একদিন দোকানদার আরো একটু মজা করার জন্য তাকে বললেন— ‘আচ্ছা ভাইপো, রাতের বেলা তুমি যখন ঘুমাও, তখন পাখির বাচ্চাগুলো উড়ে যাচ্ছে না তো!’
বোকারাম কপাল চাপড়ে বলল —‘আমি কী বোকা দেখেছ কাকু, সত্যি এটাতো ভেবে দেখিনি! রাতে পাহারা দিতে হবে তো!’ বোকারাম চলে যেতেই দোকানদার হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি!
রাত্রিবেলা মা ঘুমিয়ে পড়তেই বোকারাম চুপি চুপি বাড়ির পিছনে অপেক্ষা করতে লাগল। কখন পাখি উড়ে যায় সে দেখবে। একবারও ভাবল না যে রাতে পাখি ওড়ে না। গা-হাত-পাতো মশার কামড়ে ফুলে গেল। জ্বরে পড়ল বোকারাম। মা তার পা-হাত দেখে বললেন —‘কোথায় গিয়েছিল? এত মশা কামড়ালো কখন?’ বোকারাম চুপ করে থাকে, কিছুতেই বলতে চায় না সে। এদিকে জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকে সে —‘পাখি কখন উড়ে যাবে। পাহারা দিতে হবে।’ এরকম অসংলগ্ন কিছু কথা মায়ের কানে যায়। প্রায় পনের দিন পর ওষুধ, পথ্যি খেয়ে উঠে বসে বোকারাম। মা তাকে পাখির কথা জিজ্ঞাসা করলে সব কথা খুলে বলে মাকে।
‘সত্যি, তুই চিরকাল বোকাই রয়ে গেলি বাবা! আর কবে একটা কাজের মতো কাজ করবি বলতো?’
এমন সময় বাড়ির পিছন থেকে পাখির কিচির মিচির শব্দ শুনে মা-ছেলেতে ছুটে গেল। দেখল —এতদিন ধরে যত দানা সে লাগিয়েছিল, সব গাছগুলো ফুলে ফলে ভরে গেছে। আর কত রংবেরঙের পাখি এসেছে তার বাগানে ফল খেতে। রঙিন প্রজাপতিরা ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বোকারাম তো আন¨ে লাফাতে লাগল। আর মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন —‘এতদিনে তুই কাজের কাজ করেছিস খোকা, বোকামির হাত ধরেই তোর পুনর্জন্ম হল রে! এ যেন ‘শাপে বর’ হলো খোকা। যা ফলগুলো বাজারে বেচে আয়। আর আমাদের কোনো অভাব থাকবে না রে!’
ছেলেকে চুমায়-চুমায় ভরিয়ে দিলেন মা। তাঁর কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল আনন্দাশ্রু।