ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
রাজ্যটার নাম হাম্বা। আর সেই রাজ্যের রাজার নাম গাম্বা। তিনি এখন মাঝে মাঝেই রাগে, দুঃখে সাম্বা নাচের ভঙ্গিতে লাফানোর চেষ্টা করেন আর ব্যথায় চেঁচিয়ে ওঠেন। কারণ তাঁর বিপুলাকার ভূঁড়ি আর মোটা বেলুনের মত চেহারা। তার কিছু ভাল লাগে না। খালি ভালো-মন্দ খাবার পেট পুরে খান আর কোনরকমে সভায় এসে বসেন। সারাদিন চিন্তা, মন্ত্রী, সেপাই, সান্ত্রী, লেঠেল সব্বারই কেমন সিলিম চেহারা আর তার কিনা একেবারে ওয়ান টোয়েন্টি ফোর ওজন। রাজার ভারী দুঃখ। কী করে সিলিম চেহারা হয়। সভাকবিতো একদিন রাজাকে নিয়ে সভায় স্বরচিত করিতা পাঠ করে ফেললেন,
‘‘আমাদের রাজা নড়ে নাকি হাঁটে না
ভোজনের বাহারে কারো মানা খাটে না।
আয়তনে হারালেন মোটা কোলাব্যাঙকে
খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিলে রেগে ওঠে ধমকে,
চলা-ফেরা, ওঠা-বসা বুঝি যায় থমকে।
রোগা হওয়া চাই তার পারবে কে জানাতে
রাজা তাকে পারবেই লাখপতি বানাতে।’’
কবির ঘোষণা শুনে সবাই নড়ে চড়ে বসল। একজন উঠে বলল, ‘‘মহারাজ আমার ভাইপো জানে ভাল কুংফু। একেবারে রোগা পটকা, তালপাতার সেপাই। তাকে ডেকে আনব? সে জানে রোগা হওয়া ওষুধ।’’ মহারাজ রেগেমেগে বললেন, ‘‘গর্দভ দেখছ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি না, আর আমি শিখব কুংফু।’’ কেউ উপদেশ দিল, ‘‘সকালবেলায় এক গ্লাস নিমপাতার রস খান আর একশো বার ডন-বৈঠক করুণ। দেখবেন হাতে নাতে ফল।’’ কেউ বলল, ‘‘মহারাজ সপ্তাহে তিনদনি উপবাস। জল ছাড়া আর কিচ্ছুটি খাওয়া চলবে না। শররের সব মেদ আপনিই ঝরে যাবে।’’ মহারাজ বললেন, ‘‘সকালে ঘুম ভাঙলেই আমার ভীষণ খিদে পেয়ে যায়। একগ্লাস ছাতুর শরবত আর একসের দুধ না খেলে এবং জলখাবারে আধডজন ডিম না খেলে আমার পেট চুঁইচুঁই করে। এসব না খেলে আমি অনাহারে মারা যাব। তোমরা কি সেইটে চাও?’’ না না করে উঠল সমস্বরে। সভার এককোমে একজন শান্ত ভাল মানুষ গোছের লোক বসছিল, সে উঠে দাঁড়াতেই মহারাজ আগে ভাগেই বললেন, ‘‘তুমি কি এবার আমাকে জিমখানায় পাঠিয়ে ডাম্বেল, মুগুর ভাঁজতে বলবে নাকি ট্রেড মিলে হাঁটতে বলবে?’’ লোকটি মাথা চুলকে বলল, ‘‘না মহারাজ, এখান থেকে প্রায় পাঁচ ক্রোশ দূরে একটা কালী ম¨ির আছে। সেখানে এক সাধুবাবা থাকেন। তিনি অনেকের অনেক অসুখ সারিয়ে দিয়েছেন। তিনি এইসব নানারকম ওষুধ দেন। আমি একদিন তাঁকে আপনার মোটা হওয়ার অসুখের কথা বলেছিলাম।’’ উনি বললেন, ‘‘মহারাজকে একবার আমার কাছে নিজে আসতে হবে। আমি অসুখ সারিয়ে দেব।’’ মহারাজতো এই কথা শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, ‘‘আমি কালই যাব সাধুবাবার কাছে। মন্ত্রী, তুমি কাল প্রত্যুষেই আমার যাওয়ার ব্যবস্থা কর।’’
তারপর দিন সাধুবাবার কাছে মহারাজ সাতসকালেই হাজির হলেন। সাধুবাবা মহারাজকে দেখেই বুঝলেন, এ মানুষ খায়দায় পরিশ্রম করে না, তাই শরীরের ক্যালরিও ঝরে না। তাই মেদ জমে এমন হাতির মত স্থুলকায় হয়েছে। সাধুবাবা একটা লেবু গাছের ফুল নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে মহারাজের হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘মহারাজ, আপনি এই পুষ্প নিয়ে বাড়ি গিয়ে গরমজলের সাথে খাবেন। কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমার কাছ থেকে ফুলটা নিয়ে দৌড়ে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। পথে কোথাও দাঁড়ালে চলবে না। দাঁড়ালেই ফুলের ওষুধ কাজ করবে না। শুনে মহারাজের মনটা চুপসে গেল। তিনি হাঁটেনই না, আবার দৌড়ান, তবু নিজের শরীরের দুরবস্থার কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলেন। সাধুবাবা আরও বললেন, ‘‘আপনি যদি একমাস করতে পারেন, আপনার অসুখ নির্ঘাত সেরে যাবে।’’
মহারাজ সেদিন থেকেই ওষুধ নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে রাজবাড়ির দিকে ছুটলেন। খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভাবছিলেন এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে যায়। তবু না থেমে ছুটতে লাগলেন। প্রথম দুচারদিন দৌড়ে কষ্ট হলেও বাড়ি পৌঁছে ফুলের ওষুধ খেয়ে গরম জলে পান করে একটু স্বস্তি পেতেন। আস্তে আস্তে সব সয়ে গেল। এখন রোজ মহারাজ পাঁচ ক্রোশ রাস্তা দৌড়ে যান আর সাধুবাবার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে দৌড়ে আসেন। দিন কুড়ি পর হঠাৎ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন তাঁর চেহারা অনেক ঝরে গেছে। খুশীতে চোখ দুটো তাঁর চক্চক্ করে উঠল। একমাস পর মহারাজ অনেকখানি মেদ কমিয়ে এবুং সুস্থ শরীরে হাঁটাচলা, এমনকি চেষ্টা করলে সাম্বা নাচও করতে পারেন বুঝলেন। তিনি সাধুবাবাকে অর্থমূল্য পুরস্কার দিতে গেলে সাধু বললেন, ‘‘মহারাজ আপনি আমাকে বিশ্বাস করে যে কর্মসাধন করেছে: ওটাই আমার পুরস্কার। এরপর থেকে আপনি রোজ দৌড়ে আমার কাছে আসবেন আর সহজেই রাজবাড়ি ফিরে যাবেন। দেখবেন আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। সত্যিই একবছর পর এক বিদেশের দূত এসে মহারাজের চেহারা দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কি মহারাজ আপনি এমন অসাধ্য সাধন কী করে করলেন? মহারাজ বললেন —‘ম্যাজিক।’