ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
একটু দাঁড়াবে না? আমেরিকার টেনেসি রাজ্যের ক্লার্ক্সভিল শহরের কলেজ স্ট্রীট ধরে হাঁটতে হাঁটতে যখন এত দূর এসেই গেছ তখন আরেকটু এগিয়ে যাবে না? ঐ কুম্বারল্যান্ড নদী পর্যন্ত? হ্যাঁ, ঐ যেখানে ব্রোঞ্জের মূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে। যার নিচে লেখা আছে— দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুত দৌড়বাজ নারী। এক পলক তাকাও মূর্তিটার দিকে— সে যেন এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারছে না। এখুনি দৌড় দেবার জন্য যেন অস্থির হয়ে উঠেছে।
ওর বাঁ পা-টা কি একটু বেঁকা? ডান পায়ের চেয়ে একটু সরু? তাও তো ঐ মূর্তির নারী ছুট লাগাবার জন্য ছটফট করছে। কান পেতে একটু শোনো না— সে কি বলতে চাইছে?
কত স্মৃতি! হার না মানার জেদ! এক বল্গাহীন উদ্দাম স্বপ্নের কাহিনী।
‘আহা ও মা!’ টেনেসির ব্রেন্টবুডে নিজের বাড়িতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে উইল্মা সেদিন কাৎরাচ্ছিল। তার বয়স তখন চুয়ান্ন। বেচারী তখন জলটুকুও গিলতে পারে না। তার ওপর মাথা ব্যথার কষ্টটা তো আছেই। ‘একটু জল দাও না মা।’
কিন্তু তার ব্লাঞ্চি তখন কোথায়? গত জুলাইতেই তো সে এ পৃথিবী ছেড়ে চির দিনের মত চলে গেছে। আর সেদিন তার আদরের মেয়ে উইল্মা গ্লোডিন রুডল্ফের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়েছিল।
উইল্মা গেছিল ডা. জ্যাকোয়েস কোস্ত্যেয়ুকে দেখাতে। তার মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো দেখতে দেখতে ডা. জ্যাকোয়েস কোস্ত্যেয়ু হঠাৎ চুপ করে গেছিলেন। ঠিক যেমন অগাস্ট সেপ্টেম্বার মাসে টেনেসির আকাশ হঠাৎ কালো মেঘ ছেয়ে গেলে চারিদিকটা কেমন থম থম করে ওঠে।
‘কি ব্যাপার, ডাক্তার? রিপোর্টে কি কিছু বেরিয়েছে?’ উইল্মা রুডল্ফ ডাক্তারের টেবিলের ওপর নিজের কনুই দুটো রেখে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইল। ছেলেবেলা থেকে কত কিছুই তো হয়েছে তার। সবচেয়ে প্রথমে ধরা পড়লো তার বাঁ পায়ে পোলিও হয়েছে। তারপর হল নিমোনিয়া। আবার স্কার্লেট ফিভার। আরেকটু বড় হল তো চিকেন পক্স, মিজিল্স আর তারপর আবার ডিপথেরিয়া। বারো বছর বয়স পর্যন্ত তাকে একটু লেঙরে চলতে হতো।
উইল্মার বাবা এড ছিলেন সেখানকার রেলওয়ের কুলি। এদিক সেদিক অন্যান্য কাজও যেত জুটে। তার মা ব্লাঞ্চি ধনীদের বাড়িতে রান্না করে, কোন বাড়িতে কাপড় কেচে বা বাসন ধোয়ার কাজ করে অল্প স্বল্প কামিয়ে নিত। এত করেও বাইশটি সন্তানকে দুই বেলা পেট ভরে খেতে দেওয়া তো চাট্টি খানি কথা নয়। যখনই তাদের পরিবারে খাওয়াপরা নিয়ে বা অন্য কোন অভাব বা সঙ্কট দেখা দিত তখন মা তাদের বলত, ‘যীশুর ওপর ভরসা রাখ। তিনিই সমস্ত কষ্টের ত্রাতা।’
ইদানিং কয়েক মাস থেকে তার গলাতে ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছিল। ক্রমশ সে আর জলটুকুও খেতে পারত না। এক ফোঁটা জল খেতে গেলে যেন প্রাণটা বেরিয়ে যেত। আর তার সাথে শুরু হল মাথা ব্যথা। উইল্মা ভালো মতই বুঝতে পারলো যে এবার ডাক্তার না দেখালেই নয়।
সর্বপ্রথম সে তাদের ডাক্তার গলফের কাছেই গেছিল। তিনিই বলে দিলেন একবার ই.এন.টি স্পেশালিস্টকে দেখিয়ে নিতে। তারপর আবার নিউরোলজিস্ট দেখাতে ছুটতে হল। সি. টি এবং এম. আর. আই রিপোর্ট আসতেই ডা. জ্যাকোয়েস তাকে ফোন করলেন, ‘স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে একবার দেখা করে যেও।’
স্টেডিয়াম? এই কষ্টের মাঝেও তার যেন হাসি পেল। বললো, ‘সে পাট তো কবেই চুকে গেছে ডাক্তার কোস্ত্যেয়ু।’
শেষ পর্যন্ত তাই হল, যেটার ভয় ছিল। এক ডাক্তারের কাছ থেকে অপর ডাক্তারের কাছে। তার ওপর নানা টেস্ট তো আছেই। তবু উইল্মার মনে একটা আশঙ্কা তো হয়েই গেছিল। শুধালো, ‘ডাক্তার কোস্ত্যেয়ু, বলেই দিন না ঠিক কিসের ভয় পাচ্ছেন আপনারা?’
মানুষের জীবনটাই তো একটা পরীক্ষা। কিন্তু স্বয়ং নিজের পরীক্ষা নেবার জন্য প্রচন্ড সাহসের প্রয়োজন। উইল্মা মনে মনে সে সাহসই জোটাচ্ছিল— আমাকে ডাক্তার যাই বলুক না কেন, আমি সেটা অবশ্যই সহ্য করতে পারবো।
‘তোমার গলায় ক্যান্সার হয়েছে। এবং সেটা আবার মস্তিষ্ক পর্যন্ত ছড়িয়েছে।’ কোস্ত্যেয়ু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে উইল্মাকে দুটো সান্ত্বনার কথা বলবেন না তা এখন থাক। কে বলতে পারে সান্ত্বনার কথাগুলো তার ক্ষতটাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে না তাতে কোনও প্রলেপ দেবে?
নিজের বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে উইল্মা বাড়ি ফিরে এলো। আর কি? এর পর তার চিকিৎসা আরম্ভ হয়ে গেল। অজান্তেই সে তার মনের মাউসটাকে ক্লিক করে ফেলল এবং এক অদৃশ্য স্ক্রীনে এক এক করে তার জীবনের নানা দৃশ্য ফুটে উঠতে লাগলো—
নিগ্রো ছেলে মেয়েদের জন্য স্থাপিত বার্ট হাইস্কুলের স্পোর্টস ফিল্ড। বারো বছরের উইল্মা ফিল্ডের এক কোণে বসে আছে। ফিল্ডে কেউ ভলিবল খেলছে, আবার কোথাও বাস্কেট বল চলছে। এক ধারে টেনিস, তো আরেক দিকে ফুটবল। তার বড় বোন য়োলান্ডা ছিল বাস্কেট বলের টিমে। সে প্র্যাকটিস করছিল। উইল্মার জীবনে কোন খেলাই ছিল না।
তার করার কিই বা ছিল? একে তো সে জন্ম থেকেই দুর্বল। হামাগুড়ি দেয়া শুরু করতে না করতেই বাঁ পায়ে পোলিও ধরা পড়ল। ডান পায়ের তুলনায় সেটি সরু হয়ে উঠল। গোড়ালির কাছ থেকে পা’টাই একটু বেঁকে গেল। তারপর থেকে তো মেটালের রিং আর রডই হল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী।
সালটা ছিল ১৬৭২। আফ্রিকা থেকে দাসেদের ব¨ী করে নিয়ে একটি জাহাজ এসে নোঙর করলো যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার পূর্ব দিকের রাজ্য ভার্জিনিয়ায়। সেই ভার্জিনিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমের রাজ্য হল টেনেসি। একশো বছর আগেও সেখানে বাড়ির কাজ থেকে শুরু করে কাপাসের খেতে বা কল কারখানায় ঐ আফ্রিকা থেকে বন্দী করে আনা নিগ্রো ক্রীতদাসেরাই সমস্ত কাজ করত। আফ্রিকার পশ্চিম দিকের দেশ সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো বা অ্যাঙ্গোলা থেকে ছেলে বুড়ো মায় বাচ্চাদেরও শেকলে বেঁধে জাহাজে করে এখানে এনে গোলাম বাজারে বিক্রি করে দেয়া হত। ১৮৬১ সালে ক্রীতদাস প্রথা আইনত বন্ধ হয়ে গেলেও সাদা কালোর ভেদাভেদ তো তখনও বজায় ছিল।
‘মম, খেয়ে নিয়েছ?’ ব্লাঞ্চির এপ্রনের কোণটা ধরে ছোট্ট উইল্মা শুধালো। দুর্বল শরীরে তার অনুভূতিগুলো বুঝি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল।
ব্লাঞ্চি মিছে মিছিই এপ্রন দিয়ে নিজের মুখটা মুছে নেয়, ‘হ্যাঁ রে।’
‘মিথ্যে কথা।’ সে মায়ের বাটির ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল। তাতে শুধু এক টুকরো ব্রেড পড়ে ছিল।
মা এবং তার মেয়ের মধ্যে এটুকু নাটক কোন নতুন কথা নয়। ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দার দরুণ এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষে লক্ষ লক্ষ আমেরিকাবাসি খিদের জ্বালায় যেন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিল। কারখানা থেকে কারো হল ছাঁটাই, আবার কারোকে বলা হল, ‘কাল থেকে কাজে আসতে হবে না।’ ব্ল্যাকেরা কিভাবে জোটাবে দুবেলা দুমুঠো অন্ন? ওরা থাকতো এদেশের বস্তির মত টিনের ঘরের ঘেটোয়। না খাবার জলের ব্যবস্থা, না পরনে উপযুক্ত কাপড় জামা। রাস্তার ধারে আবর্জনার স্তূপ আর তারই মাঝে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে শুয়োরগুলো। ট্যাক্সের ব্যাপারে সাদায় কালোয় কোন প্রভেদ ছিল না। স্কুলে সাদা কালো ছেলে মেয়েদের শিক্ষার খাতে সরকার যা দিত তার অতি অল্পই জুটত এদের কপালে।
সাদা কালো স্টুডেন্টদের জন্য ছিল আলাদা আলাদা স্কুল। গোরাদের রেস্টুরেন্টে তাদের ঢোকাও বারণ ছিল। যেন দুটো আলাদা জগত। উইল্মার জন্মের সময় ব্লাঞ্চিকে নিয়ে এড ক্লার্ক্সভিলের সমস্ত হাসপাতালে মাথা খুঁড়ে মরেছে কিন্তু কোথাও তাদের ঢোকার অধিকার ছিল না। ক্লার্ক্সভিল শহরে কালা আদমিদের জন্য শুধু একজন ডাক্তারই ছিল। যখন উইল্মার বয়স চোদ্দ তখন আমেরিকায় বর্ণভেদ নীতি বাতিল হয়ে গেলেও ডাক্তার মার্টিন লুথার কিং এর মত নেতৃস্থানীয় লোকেদেরও পথে নামতে হল। তারা পথে পথে শ্লোগান দিতে লাগলো— ‘তোমাদের স্কুলে আমাদের ছেলে মেয়েদেরও পড়তে দিতে হবে!’ ‘বাসে আমরা একসঙ্গেই বসতে চাই!’ ‘সাদা আর কালো মানুষ একই কাজ করলে তাদের মাইনেও যেন এক হয়!’ ‘তোমাদের রেস্টুরেন্টে বসে আমরাও খাবার খেতে চাই!’ অর্থাৎ সম নাগরিক অধিকারের দাবিতে সব্বাই যেন মুখর হয়ে উঠল।
এমতাবস্থায় ছেলে বেলায় তো উইল্মাকে বড় ভাই বোনেরাই পড়াত। কয়েক বছর পর তাকে বার্ট হাইস্কুলে ভর্তি করে দেয়া হল।
নিজের স্কুল ব্যাগটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে সে প্রত্যহ স্কুলে যেত। চেয়ে চেয়ে দেখত তার বোনেরা কেমন ভাবে বাস্কেট বল খেলছে। সে ছায়ার মত নিজের দিদির সাথে সেঁটে থাকত। একদিন হঠাৎ সে দিদিকে জিজ্ঞেস করল, ‘য়োলান্ডা, আমি তোদের সঙ্গে স্কুলে টিমে খেলতে পারি না?’
‘তুই?’ য়োলান্ডার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বোনকে কি সান্ত্বনা দেবে সে? বলল, ‘কিন্তু তুই খেলবি কি ভাবে?’
উইল্মার মনে পড়ে—
সেদিন স্কুলে ফাদার ফ্রান্সিস জেভিয়ার বাইবেলের স্যামুয়েল এর প্রথম পাঠ থেকে ডেভিড আর গলিয়াথের গল্প শোনাচ্ছিলেন। বার্ট একাডেমির খেলার মাঠে বসে থাকতে থাকতে উইল্মার চোখের সুমুখে যেন সেই গল্পের শব্দগুলোই প্রাণ পেয়ে সজীব হয়ে উঠলো।
তখন প্যালেস্টাইন আর ইজরাইলের যুদ্ধের দামামা উঠেছিল বেজে। শোখো এবং অজোকা নামক দুটি জায়গায় প্যালেস্তিনিদের শিবির প্রস্তুত হল। ওদিকে রাজা সলের ইজরাইলি সেনাদের আস্তানা হল পাহাড়ের নিচে এলা নামক স্থানে। এমন সময় প্যালেস্তিনিদের শিবির থেকে বেরিয়ে এলো সাড়ে ছ’ হাত লম্বা এক দৈত্যাকার মানুষ। সে হল পথ নিবাসী গলিয়াথ। মাথায় তার পিতলের মুকুট। বুকের ওপর পিতলের কবচ। মাথা থেকে পা পর্যন্ত পাঁচ হাজার শেকেল ওজনের পিতল নিয়ে সে চলাফেরা করত। প্রাচীন ইহুদীরা শেকেল দিয়েই জিনিসপত্র ওজন করত। এক শেকেল অর্থাৎ এ যুগের প্রায় এগারো গ্রাম। তাঁতিদের তাঁতের মত লম্বা বিশাল গদা নিয়ে সে অবলীলাক্রমে যুদ্ধে নেমে পড়ত। যুদ্ধক্ষেত্রে এসে সে চেঁচাতে লাগলো, ‘কি রে, তোরা সব্বাই এক সঙ্গে মরতে চাস কেন? তার চেয়ে বরং কোনো এক জনকে পাঠিয়ে দে— আমার মোকাবিলা করতে। যদি সে ব্যাটা জিতে যায় তো আমরা সমস্ত প্যালেস্তিনিরা তোদের গোলাম হয়ে থাকবো। আর আমি যদি তাকে শেষ করে দিতে পারি তো সমস্ত ইজরায়িলিরা হবে আমাদের দাস। কেমন?’
এই দৈত্যকে দেখে তো রাজা সল এবং অন্যান্যরা সবাই বেশ ঘাবড়ে গেলেন।
সে যুগে বেথেলহ্যামে জেসি নামে এক বৃদ্ধ থাকত। তার আট ছেলে। বড় তিনটির নাম হল— ইলিয়াব, অবিনাদাব আর সম্মাহ। এরা তিন জনেই রাজা সলের সৈনিক। তারা ঐ যুদ্ধের ময়দানেই উপস্থিত ছিল। ডেভিড হল এদের সবচেয়ে ছোট ভাই। তার কাজ ছিল প্রতিদিন বাড়ির ভেড়াগুলোকে মাঠে নিয়ে যাওয়া।
একদিন জেসি ডেভিডকে ডেকে বলল, ‘যা বাছা, দশটা রুটি আর সব্জি নিয়ে যা নিজের দাদাদের খোঁজ নিয়ে আয় যে ওরা কেমন আছে। সঙ্গে সেনাপতিদের জন্য নজরানা হিসেবে একটু পনীর নিয়ে যাস।’
দ্বিতীয় দিন রুটি, তরকারি আর পনীর নিয়ে ডেভিড গিয়ে হাজির হল লড়াইয়ের ময়দানে। সেখানে গিয়ে দেখে প্রত্যহের মত গলিয়াথ তখনও তারস্বরে যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে, ‘হিম্মৎ থাকে তো চলে আয় আমার সাথে লড়তে।’
তখন সেই বালক ডেভিড সৈনিকদের জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, কোনও ইজরায়েলি যদি ওকে মেরে ফেলতে পারে তো রাজা তাকে কি দেবেন?’
‘সে আর বলতে? তার গাঁঠরি সোনা দানায় ভরে দেবেন। তার সমস্ত কর মাফ করে দেবেন। আর রাজকন্যেকে দেবেন তার হাতে তুলে।’
‘তাহলে আমি ওর সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি।’
ইতিমধ্যেই ইলিয়াব এসে ভাইকে বকতে থাকে, ‘তুই কি যুদ্ধটাকে ছেলে খেলা মনে করছিস নাকি?’
একটা ছোট ছেলে ঐ গলিয়াথের সাথে লড়তে চায় শুনে সল তাকে ডেকে পাঠালো, ‘তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয় কিন্তু তুমি তো নেহাত বালক।’
ডেভিড হাত জোড় করে বলল, ‘রাজা, একদিন আমি তখন মাঠে ভেড়া চরাচ্ছিলাম তখন একটা সিংহ আর একটা ভাল্লুক ভেড়াগুলোকে খাবে বলে তেড়ে এসেছিল। সেদিন আপনার এই দাস তাদের দুজনকেই শেষ করে দেয়। আমি বিশ্বাস করি আমার প্রভু আজও আমাকে রক্ষা করবেন।’
তখন রাজা সল তাকে নিজ হাতে কবচ পরিয়ে দিয়ে সৈনিকদের বললেন, ‘ওকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত করে দাও।’ কিন্তু ডেভিড সেসব নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এসব পরে তো আমি লড়তেই পারবো না।’ তারপরেই সে নিজের ঝোলাটা ঝুলিয়ে নিল কাঁধে, হাতে তুলে নিল লাঠিটা। অন্য হাতে ছিল তার গুলতি। এরপর সে বেরিয়ে পড়ল গলিয়াথের সঙ্গে মোকাবিলা করতে। যেতে যেতে সে নদীর তীর থেকে পাঁচটি টুকরো কুড়িয়ে থলেতে ভরে নিল।
কিন্তু তাকে দেখে তো গলিয়াথ ভীষণ খেপে গেল, ‘কি রে তুই কি আমাকে কোন কুত্তা ভাবিস নাকি যে একটা লাঠি হাতে আমার সাথে লড়তে চলে এলি? তবে চলে আয় ব্যাটা। আজ আমি তোর মাংস দিয়ে শেয়াল শকুনকে ভোজ খাওয়াবো।’
ডেভিডও তো আর ভয় পাওয়ার পাত্র নয়। সে বলল, ‘ইজরায়েলের ঈশ্বরের নামে এই যুদ্ধ। তিনিই আজ আমার হাতে তোর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবেন।’
দুই যোদ্ধা মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। তখনই থলে থেকে একটা পাথর বের করে গুলতিতে লাগিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ডেভিড গলিয়াথের মাথা লক্ষ্য করে দুম করে ছুঁড়ে দিল। পরক্ষণেই সেই প্যালেস্তিনি যোদ্ধা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল।
তারপর আর কি? ইজরায়েলি সেনা বিজয়োল্লাসে একেবারে ফেটে পড়ল।
ডেভিড যেভাবে নিজের বর্ম আর মুকুট ফেলে দিয়ে ছিল, তেমনি ভাবেই উইল্মাও নিজের পায়ের রড আর রিং খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল, ‘যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়। আমাকে খেলতেই হবে।’ যেন ওগুলোই ছিল তার পায়ের বেড়ি। কোন রকমে সে উঠে দাঁড়াল।
দুম্! ঠিক তখনই বাস্কেট বলটা এসে পড়ল তার সামনে। বলটাকে মাটিতে ড্রপ করতে করতে সে ভিড়ে গেল খেলোয়াড়ের সঙ্গে।
তাকে দেখে দু-একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুই আবার কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলি?’
মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল য়োলান্ডা, ‘এ কি! ছুটকি বল নিয়ে দৌড়চ্ছে! এ স্বপ্ন না সত্যি?’
‘উইল্মা, তুমি বসে যাও। কে তোমাকে মাঠে নামের পারমিশন দিয়েছে?’ স্কুলের কোচ মিঃ ক্লিনটান গ্রে অযথাই তার ওপর রেগে গেলেন। একবারও ভাবলেন না যে তিনি একটি বাচ্চা মেয়ের স্বপ্নটাকে দলে পিষে শেষ করে দিচ্ছেন।
‘স্যার, প্লীজ। ওকেও প্র্যাকটিসে নিয়ে নিন না।’ য়োলান্ডার কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়ে।
‘নো। ইউ জাস্ট শাট আপ।’ ক্নিনটান একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন।
শেষ পর্যন্ত স্কুলের থেকে পারমিশান নিয়ে তার বাস্কেট বল খেলা আরম্ভ হলো। এই হল তার যাত্রা পথের শুরু। এড এবং ব্লাঞ্চির মনে হল ঈশ্বর যেন শেষ পর্যন্ত তাদের প্রার্থনা শুনেছেন। ব্লাঞ্চির মনে হল নিজের অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে পঞ্চাশ মাইল দূরে নেশভিলের মের্হারি হাসপাতালে যাওয়া তার ব্যর্থ হয়নি। সেখানকার ডাক্তারও মনে মনে ভাবত— আহারে! এই অভাগা দরিদ্র বাবা মা কিভাবে শেষ কপর্দকটুকু দিয়ে আর চুড়ান্ত কষ্ট করে চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে তাদের মেয়েটা নিজের পায়ে অন্তত দাঁড়াতে পারে।
তাই তো তিনি একদিন ব্লাঞ্চিকে বলেছিলেন, ‘ও তো রড আর রিংগের সাহায্যে নিজেই এখন চলতে পারে। তাই তুমি নিজেই তো রোজ ওকে এক্সারসাইজ করাতে পারো। সপ্তাহে তিন বার করে এত দূর ওকে আনার দরকার কি?’
দারিদ্রের ঝোড়ো হাওয়াটা কিন্তু তাদের ভাই বোনেদের মনের হাসির প্রদীপটাকে নিবিয়ে দিতে পারেনি। তার ভাই ক্লডি একদিন ঠাট্টা করে বলল, ‘এবার তো তোর একটা ট্র্যাক সুটের দরকার। সেটাও কি ঐ চটের কাপড় দিয়েই হবে নাকি?’
‘ধ্যাত!’ সব্বাই হেসে উঠল। এভাবেই হাসির দমকা হাওয়ায় তাদের মনে কোনও কালো মেঘ জড় হতে পারত না।
আসলে ব্যাপারটা হল এই যে এড রেলওয়ে থেকে চটের থলে এনে দিত। ব্লাঞ্চি তা দিয়েই ছেলেদের শার্ট আর মেয়েদের ফ্রক সেলাই করে দিত, ‘দেখ দিকি য়োলান্ডা, এই ফ্রকটা তোর পছন্দ হয়েছে?’
‘খুব সুন্দর হয়েছে, মা। আমার গায়ে বেশ মানাবে।’
‘ঘেরের ওপর সাদা লেস দিয়ে একটু ঝালরের মত করে দিই?’
সেদিন ক্লডি য়োলান্ডাকেও ছেড়ে কথা কয়নি, ‘তাহলে তো তোকে সেই কারওয়ালী ম্যাডাম স্কারলেটের মত লাগবে রে।’
খেলার মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে বোনেরাও হাসাহাসি করত, ‘বলটা হাত নিয়ে লাফ দিতেই সামনের দুজনের মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে গেল। ব্যাস্, সেই সুযোগেই আমি বলটা বাস্কেটে ড্রপ করে দিলাম।’
সেবারে ডিসেম্বারে এডি বলল, ‘এ বছর ক্রিসমাসে আমাদের ছেলেমেয়েরাও নতুন শার্ট প্যান্ট আর ফ্রক পড়বে।’
রাতে যখন অ্যাটলান্তিকের ঠান্ডা হাওয়া এসে তাদের জানলার কাঁচে করাঘাত করছিল তখন উইলামা এসে মা’কে বলল, ‘মা, এ বছর আমার জন্য তো তোমাদের অতগুলো টাকা খর্চা হয়ে গেছে। আমার ঐ চটের ফ্রকই যথেষ্ট। ওটাতে একটু সাদা লেসের ফুল লাগিয়ে দিও মা।’
ব্লাঞ্চি কোন কথা বলতে পারলো না। তার গলায় কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠেছে।
চব্বিশ তারিখের সন্ধ্যে বেলায় পাড়ার বাচ্চাদের টফি চকোলেট বিলি করার জন্য সাজানো ঘোড়ার গাড়ি চেপে সান্তা ক্লজ এসে হাজির হল, ‘বাচ্চারা, মেরি ক্রিসমাস!’
পথের এক পাশে দাঁড়িয়েছিল উইল্মা। কালোদের পাড়ায় প্রতিটি জানলায় যেন নেমে এসেছে আকাশের উজ্জ্বল তারা।
সান্তা তার দিকে এগিয়ে এলো, ‘ওগো ছোট্ট পরী, আজ তোমার কি চাই, বল।’ সান্তার সাদা দাড়িতে যেন বরফের রং লেগেছে।
‘সান্তা, আমাকে একটা বাস্কেট বল দাও না।’
তারপর? উইল্মার মনে হতে লাগলো—
বলটাকে ড্রিবিল করতে করতে সে যেন সারা মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পোলিও তার কাছে পরাজিত হয়েছে।
কিন্তু তার দুঃখ কষ্ট এবং বেদনা এই দুয়ের মাঝেও যে তাকে অনেকখানি পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। কে জানে কেন ক্লিন্টন গ্রে তাকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারতো না। উইল্মাকে দেখলেই লোকটা যেন মনে মনে ভাবত— এই খোঁড়া মেয়েটা কি ভাবে নিজেকে? সব সেরা চ্যাম্পিয়ান? অর্থাৎ শুধু মাত্র সাদা মানুষেরাই নয়, কালো মানুষেরাও একে অপরকে লেঙ মারতে কসুর করতো না। তিন বছর পর্যন্ত সে উইল্মাকে স্কুলের টিমে ঢুকতেই দিল না। উইল্মা দিনের পর দিন ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিয়ে চলল। সঙ্গে চলল তার প্রতিদিনের দৌড়ের প্র্যাকটিস। শেষ পর্যন্ত টেনেসি রাজ্যের মহিলা ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড কোচ এডওয়ার্ড টেম্পলের নজর পড়ল তার ওপর। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন, ‘তোমাদের বার্ট স্কুলে তো ট্রেনিং-এর কোন সুবিধেই নেই। তুমি আমাদের সামার ক্যাম্পে এসে জয়েন করো।’
জীবনের একটা বন্ধ দরজা যেন খুলে গেল। হাই স্কুলের ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড টিমে তো সে দৌড়তই, এবার সে বাস্কেট বল টিমের স্টারটিং গার্ড হয়ে গেল। স্কুল কয়েকটা মেডেল পেলো এবং তার ঝুলিতেও বেশ কয়েকটা পদক এলো। যখন তার বয়স ষোল টেম্পল তাকে অলিম্পিক কমিটির সামনে দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য পেশ করলেন। তার সিলেক্সান হয়ে গেল। তারপর তো দৌড় দৌড়, কত না ঘাম ঝরানো, কত না তেষ্টা— ওহ মা, কেটু জল! না এখন জল খাওয়া চলবে না। চলতে থাকে নিরলস প্র্যাকটিস। সামনে রয়েছে ১৯৫৬-র অলিম্পিক। তাতে চারশো মিটার রিলে রেসে সিলভার পেলো উইল্মা। মা তার গাল দুটো চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলেন।
দেখতে দেখতে তার দুই পায়ে যেন দুটো ডানা গজিয়ে উঠল। আজ এখানে ট্রেনিং, কাল অমুক জায়গায় এথেলিট মীট। আজ না হয় তার কাছে অনেকগুলো স্পোর্টস সু রয়েছে। কিন্তু বাবার কিনে দেওয়া সেই প্রথম জুতো জোড়ার দিকে চোখ পড়তেই তার মনে হত ওগুলো জুতো নয়, বরং কারো চোখের স্বপ্ন!
চার বছরে সব মিলিয়ে কতগুলো মাস হয়, কতগুলো দিন? আর প্রত্যেকটা দিন কতগুলো করে মুহূর্ত দিয়ে গড়ে ওঠা? দেখতে দেখতে এসে গেল ১৯৬০-এর অলিম্পিক। কেউ কি ভাবতেও পেরেছিল যে একদিন যে মেয়েটার পোলিও হয়েছিল সে দৌড়বে অলিম্পিকে? উইল্মা দৌড়ল এবং এক শো, দুই শো আর চার শো মিটার রিলে রেসে সে তিনটে গোল্ড জিতে আনল। একটাই অলিম্পিকের একই টাইপের তিনটে ইভেন্টে তিনটে গোল্ড। কজন পারে? তাও আবার একজন মহিলা হয়ে? তার আগে জেসি ওয়েন্স ছিলেন প্রথম আমেরিকাবাসী যিনি ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকে চারটে গোল্ড নিয়ে ফিরেছিলেন। উইল্মার বার বার মনে হত একবার যদি স্বয়ং জেসি ওয়েন্স তাকে দৌড়তে দেখতেন! শুধু একবারটি!
চারিদিকে প্রশংসার একবারে তুমুল ঝড় বয়ে যেতে লাগল। কোথাও তার নাম দেয়া হল ঝোড়ো হাওয়া। ফরাসিরা নাম দিল— কালো মুক্তো। (ব্রাজিলের প্রবাদ প্রতিম ফুটবলার পেলেকেও লোকে বলত— ব্ল্যাক পার্ল বা কালো মুক্তো)
রোম থেকে ফিরে সে মা আর বোনেদের একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরল। ব্লাঞ্চির গলায় দুলতে লাগল অলিম্পিকের তিনটে গোল্ড মেডেল। বাবা এড মুচকি হেসে সবার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। ভাবল— আমার মেয়েটা তো আমাদের স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে আরও ওপরে উঠে গেছে। বুকের ওপর ক্রস চিহ্ন আঁকতে আঁকতে সে বলে উঠল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ গড!’
কথা উঠল তাকে নিয়ে শহরে বিজয় মিছিল বের করা হবে। সে হেসে বলল, ‘আমি তো একটা সামান্য ব্ল্যাক মেয়ে। আমি সে জায়গায় কি করে যাই যেখানে কালো লোকেদের প্রবেশ নিষেধ?’ এবার ইতিহাসের চাকা ঘোরার সময় এসে গেছিল। এই প্রথম ক্লার্ক্সভিল শহরে সাদা এবং কালো মানুষেরা একসাথে বাইবেলের সাম থেকে গান ধরল। এক সঙ্গে।
তার বাবা তাকে আদর করে বলেছিল, ‘ওরে আমার উড়ন্ত পরী, এ সম্মান তো স্বয়ং জেসি ওয়েন্সও পাননি। জানিস, চার চারটে গোল্ড পাওয়ার পরেও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি তাকে একটা টেলিগ্রাম পাঠাবার প্রয়োজনটুকু বোধ করেননি।’
হাজার হাজার দাস যাদের শেকলে বেঁধে এখানে আনা হয়েছিল তারা এবং যে কালো মানুষেরা তখন কবরের নিচে শুয়ে ছিল— সব্বাই যেন তার জন্য প্রার্থনা জানাতে লাগল।
তারপর? জীবনের রেস তো নিজের গতিতে চলতেই থাকে। স্কলারশিপ নিয়ে টেনেসি ইভনির্ভাসিটি থেকে ডিগ্রী পাওয়া, টিচারের চাকরী, বিয়ে, কোচ হওয়া, টিভির এঙ্কার হওয়া এবং চারটি সন্তানের জননী হওয়া। এরই মাঝে মার্চ ১৯৮০, জেসি চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। খুব কাঁদল উইল্মা। তারপর? তার জীবনের ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড দৌড়ে ফাইনাল পয়েন্টের রিবনটা ছোঁয়ার সময় হয়ে এলো।
১৯৯৪-এর নভেম্বরের এক শীতের রাত্রি। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার দরুন উইল্মা গ্লোডিন রুডল্ফের বোধহয় একটু ঘুম এসে গেছিল। অতলান্তিক মহাসাগরের ঠান্ডা হাওয়া ব্ল্যু রিজ পাহাড়ের ওপর থেকে ধেয়ে এসে পপলার গাছের ওপর থেকে যেন তাকে ডাকছিল, ‘উইল্মা, ওঠ। দৌড়তে যাবে না?’
উইল্মা দৌড়চ্ছে। এই পৃথিবী থেকে ঐ আকাশ পর্যন্ত ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড রেসে উইল্মা দৌড়চ্ছে। হঠাৎ সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। ‘ওহ্, মা!’ কিন্তু কে তাকে তুলে ধরল? জেসি ওয়েন্স? উইল্মা কেঁদে ফেলল, ‘জেসি, আমি যে আর দৌড়তে পারছি না। আমার পা’টাই যে পঙ্গু হয়ে গেছে।’
‘না না, উইল্মা।’ জেসি ওয়েন্সের চোখ ধ্রুব তারার মত ঝকমক করে ওঠে, ‘ওরে পাগলী মেয়ে, স্বপ্ন কখনও পঙ্গু হয় না!’
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১। টাইমস অফ ইন্ডিয়া (২৭.০৫.২০২৪)
২। অন্যথা (হিন্দী, জুন ২০০৮), লেখক- কৃষ্ণ কিশোর
৩। ইন্টারনেট