ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
‘একেই বলে গদাই লস্করি চাল!’
সকাল সাতটায় যখন ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বিকেলের প্ল্যান কষছিলো বিতান। ছোটকাকিমা এসে তখন ছাদের ঘরে দুধের কাপ দিয়ে গেছে।
আটটায় স্নান পুজো সেরে ছোটকাকিমা ছাদে কাপড় মেলতে এসে দেখলো বিতানের পড়ার টেবিলে তখনো সেই দুধের কাপখানা প্লেট দিয়ে ঢাকা দেওয়া। আর বিতান মুখে ব্রাশ নিয়ে পাখিদের ঘাসের দানা খাওয়াচ্ছে।
‘কিরে এখনো মুখ ধুষনি তুই? নীচে তো দিদিভাই তোর জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছে। একেই বলে গদাই লস্করি চাল!’ —ছোটকাকিমার ডাকে পাখিদের মাঝে একান্ত সঙ্গটায় একটু ছেদ পড়লো বিতানের।
‘এই তো যাচ্ছি কাকিমণি।’ —বলে ছাদের ছোট বেসিনটার দিকে এগিয়ে গেলো বিতান।
অনীশদের বাড়িতে আজ বিকেলেই বইগুলো নিয়ে যাবে ও। আজ বাদে কাল সরস্বতী পুজো।
বিতান আর অর্ঘ্যদীপ গতকাল বইপাড়া ঘুরে গোটা কুড়ি নতুন বই এনেছে ছোটোদের জন্য। বর্ণপরিচয়, রঙিন ছড়া, আর এ-বি-সি-ডি-র। সাথে নতুন স্লেট। আর চক-খড়ি পেনসিল। সেগুলোই আজ কোচিং-এ যাবার পথে অনীশদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। জিতেন, শঙ্খ, অর্ঘ্যদীপ সবাই ওখানেই থাকবে।
(২)
‘অনীশ বাড়ি আচ্ছিস! বইগুলো এনেছি রে!’
বিতানের ডাক শুনে গেট খুলে ওরা বাইরে এলো। বিতানের সাইকেলের ক্যারিয়ারের বাঁধন খুলে প্যাকিং করা বই, স্লেটগুলো সাবধানে নামালো। ওদের পিছন পিছন অনীশের ঠাকুরদা জ্যোতির্লাল মুখোটিও এসে দাঁড়িয়েছেন। সাথে ছোট ছোট ফুটফুটে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। সামনের হাউজিং কমপ্লেক্সের ঠিক পিছনের বস্তিটাতেই থাকে বাচ্চাগুলো। এদের মধ্যে কারোর বাবা হয়তো মিলে কিম্বা গ্যারেজে কাজ করে। আর কারোর মা হয়তো এই ফ্ল্যাটবাড়িরই ঠিকে রান্না বা সাফাই এর কাজ করে। সবারই জীবনগুলো কম বেশি একইরকম ওদের। ঘরে সেভাবে দেখবার কেউ নেই। ঘুরে ঘুরে সারাদিন খেলে বেড়িয়েই দিন কেটে যায় ওদের।
জ্যোতির্লাল মুখোটি বিতানদের বললেন—
‘এই ছোটদের সবার হাতে হাতে দিয়ে দাও বই আর স্লেটগুলো।’ —সেইমতো বিতান, অর্ঘ্যদীপ ওদের হাতে হাতে বর্ণপরিচয়, ছড়ার বই, স্লেট, পেনসিলগুলো তুলে দিলো।
কাল সরস্বতী পুজোয় এই ছোট খুদেগুলোর একটা হাতেখড়ির ব্যবস্থা করলে কি-ই বা ক্ষতি হবে। সেই ভাবনা থেকেই এসব আয়োজন। এসব ভাবনা অবশ্য জ্যোতির্লাল মুখোটির ব্রেইন চাইল্ড। অনীশ আর বিতানরা সবাই ঠাকুরদার সেই ভাবনাকে পালনের দায়িত্ব নিয়েছে চওড়া হাতের পাঞ্জা বাড়িয়ে।
(৩)
আজ শুক্ল পঞ্চমীর সকালটায় অনীশদের ছাদেই সরস্বতী পুজোর আয়োজন। দশজন খুদে সদস্যর হাতেখড়ি হবে। দারুণ উৎসাহে তারা সবাই বিতানদের হাত ধরে হাজির। পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা নিয়ে সবাই পুরোহিতের সাথেই মন্ত্রোচ্চারণে নিমগ্ন।
জ্যোতির্লাল মুখোটি করজোড়ে প্রার্থন করছেন— ‘‘দেবী মা, তোমার কাছে এই প্রার্থনা —তোমার নিরন্তর আশীর্বাদে ওদের জীবনের হাজার ঝঞ্ঝাতেও যেন শিক্ষার ধারা কখনোই স্তব্ধ না হয়। বিদ্যার আলো ওদের জীবনকে আলোকময় করে রাখুক তোমার স্নেহাশিষে!’’
খুদে মুখগুলো হাতেখড়ির পর নতুন স্লেটে আঁকিবুকি কেটে কেটে আনন্দে ঝলমল করে উঠলো।