ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
যাদুকরের যাদুবিদ্যা দেখার আগ্রহ মনে হয় আটের থেকে আশি, সবার মধ্যেই উঁকি দেয়। ছোটদের মন যাদুকরদের খেলা দেখে আনন্দে মেতে ওঠে। যাদুকররা গ্রামে গঞ্জের মেলায়, এমনকি স্কুলেও ঘুরে ঘুরে যাদুর খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। সেই রকমের এক যাদুকরের যাদুখেলার সঙ্গী হতে হয়েছিল আমায়; সেই কথাই এখন বলছি।
ঘটনাটা বেশ মজার। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের কথা। ফাল্গুন কি চৈত্র মাস হবে। বসন্তের হাওয়ায় গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। দখিনা বাতাস এর মোহময় আবেশে, শীতের সমস্ত জড়তা কাটিয়ে হাসিমুখে তার আবাহন; দ্বারে দ্বারে কড়া নাড়াচ্ছে! গ্রামের চাষীবাসী মানুষের চাষবাস প্রায় নেই বললেই চলে। সেই সময় এক যাদুকর তার ঝোলা- ঝুলি, বাক্স-পেঁটরা নিয়ে এসে হাজির। সে এখানে কিছুদিন থাকবে এবং নানা রকমের যাদুর খেলা দেখাবে। গ্রামের সবাই রাজী। সন্ধ্যেবেলা সকলে বাড়ির কাজ সেরে জড়ো হতো আমাদের মাধবপুরের শিবতলায়। যথাসময়ে খেলা শুরু হতো।
দিনকতক পরে সপ্তম কি অষ্টম দিনে কয়েকটা খেলার মধ্যে ছিল —ভুতের খেলা, ভীষ্মের শরশয্যা, আর নর-রাক্ষসের খেলা! ভীষ্মের শরশয্যা হবে, —একটা ছোট ছেলে বা মেয়ে চাই। ভুতের খেলা দেখে ছোটরা একটু ভয়ই পেয়েছে। সকলেই প্রায় মায়ের কোল ঘেঁসে বসে আছে। আমি একটু সাহসী ছিলুম, তাই সামনেই বসে ছিলুম। তাই যাদুকর আমাকেই টেনে নিয়ে গেল। বলল —এই ভীষ্ম হবে, বেশ সাহসী মেয়ে আছে।...
পর্দার আড়ালে নিয়ে গিয়ে আমাকে ভীষ্ম সাজানো হলো। লাল জামা-কাপড়, মাথায় পাগড়ি, আর একটা লোহার প্লেট আমার পিঠে বেঁধে দেওয়া হল জামাটার ভিতর দিয়ে! স্টেজে ভীষ্মকে আনা হলো। স্টেজে ভীষ্মের শরশয্যা তৈরীই ছিল —ঝকঝকে আট থেকে দশটা ধারালো তীর দিয়ে, যাদের গা থেকে আলো ঠিকরে যাচ্ছে! শোয়ানোর পরেই সব ফলা পিছন থেকে সামনের দিকে বেরিয়ে আসবে! যাদুকর এবার আমায় বলল —‘আমার দিকে তাকাও।’ আমি ভয়ে ভয়ে যাদুকরের দিকে তাকিয়ে আছি —হয়ত এক মিনিট হবে। তারপর পিছন দিকে আস্তে আস্তে আমার মাথা হেলে পড়ল। যাদুকর, আমায় ধরে নিয়ে শরশয্যায় শুইয়ে দিল। আমি বুঝতেই পারছিলুম না যে কি হচ্ছে!
এবার চারিদিকে শুধু হাততালি আর হাততালি; পর্দা গেল নেমে। আমায় শরশয্যা থেকে নামালো হল। পোশাক বদল হল। যাদুকর আমাকে কিছু বিস্কুট খেতে দিল। আমি মনের আনন্দে বিস্কুট খেতে খেতে স্টেজের থেকে বের হয়ে এলুম। সবার চোখ তখন আমার দিকে। কেমন করে তীরের উপর শুইয়ে দিল অথচ কিছুই হল না! আমার বাবা, মা ও অন্যান্য সকলেই চিন্তায় ছিল, কি হয়, কি হয়! কিন্তু সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আমি ছুটে এসে মায়ের কোলে মুখ লুকালুম। মায়ের উদ্বিগ্ন চোখে মুখে একরাশ প্রশ্ন— ‘লাগেনি তো?’... আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বললুম —‘না’।