ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবি। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব ধূমকেতুর মত। তাঁর এক হাতে বাঁশরী, অন্যহাতে রণতুর্য। নজরুল কেবলমাত্র ছোটদের জন্য লিখেছেন তা নয়। তাঁর রচনা সম্ভারের মধ্যে ছোটদের জন্য যা লিখেছেন তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
নজরুলের এবার একশ পঁচিশ বছর হল। একশ পঁচিশ বছর পরে মানুষের মনে স্থান পাওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। নজরুলকে আমরা ভুলিনি। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায়, বিদ্যাশিক্ষার আঙ্গিনায়, অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠায়, মানুষের সুর সাধনায় নজরুল বারবার ফিরে ফিরে আসেন। নজরুলের এই বহুমুখী প্রতিভাকে আমরা সম্মান জানাই।
রবীন্দ্রনাথ শিশুদের জন্য ‘শিশু’ ও ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্য লিখেছেন। কিন্তু এর বাইরে তাঁর আরো অজস্র রচনা সম্ভার। ছোটদের জন্য ভেবেছেন, কিন্তু ছোটদের ভাবনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। নজরুল ছোটদের জন্য কবিতা লিখলেও তার বাইরে তাঁর বিশাল রচনাভাণ্ডার রয়েছে। ছোটদের কাছে তিনি চলে আসেন ছোটদের কথা লিখে।
শিশুমন কল্পনা প্রবণ। কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে সে উড়ে চলে দূর থেকে দূরান্তরে। মনে তার অন্তহীন প্রশ্ন। নিরন্তর সে সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। আবার প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তার শৈশব তাই ভাল শিশুসাহিত্য বয়স্কদেরও সমানভাবে তৃপ্তি দেয়।
নজরুলের পার্থিব জীবন সাতাত্তর বছর তিনমাস হলেও তার সাহিত্য জীবন মাত্র ২৩ বছর। ১৯৪২ সালের ২৩শে আগস্ট কবি বাকরুদ্ধ হন। তার আগেই তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি শেষ হয়েছে। তাঁর রচিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এই বিচিত্র রচনাসম্ভারের মাঝে রয়েছে ছোটদের জন্য রচনা।
শোনা যায় পাবলিশারদের অনুরোধেই তিনি ছোটদের জন্য লেখা শুরু করেন। নজরুলের মধ্যে ছিল এক চিরকিশোর যে হা-হা-কার হাসিতে ঘর ভরিয়ে তোলে। গোলাম মোস্তাফার কবিতায় তার এই রূপটি ধরা পড়েছে—
‘‘কাজী নজরুল ইসলাম
একদিন তার বাড়ি গিসলাম
ভায়া গান গায় দিনরাত
হেসে লাফ দেয় তিনহাত
প্রাণে ফূর্তির ঢেউ বয়
ধরায় পর তার কেউ নয়।’’
এই অফূরণ হাসিতে ভরপুর তার ছোটদের কবিতা থেকে দু-একটি উদাহরণ দিচ্ছি—
‘‘শেয়ালের ন্যাজ
গোটা দুই প্যাঁজ
বেশ করে ভিজিয়ে
ঘুট করে খেয়ে ফেল
মুখে কেন কথা এল
কী মজার চীজএ।’’
এ রকম খাবারের বর্ণনায় না হেসে কে থাকতে পারে?
আবার—
‘‘রাস্তায় তেড়ে এল এঁড়ে এক দামড়া
ঢুঁস খেয়ে বঁটকুর ছড়ে গেল চামড়া।
ভয়ে মোটকুর চোখ হয়ে গেল আমড়া।’’
এই হাসি কিন্তু স্থূল ভাঁড়ামির হাসি নয়। এরকম আর একটি কবিতা হল ‘লিচুচোর’— যে কবিতাটি পড়ে হাসি সামলানো যায়না, যদিও দূরন্ত ছেলেটির পক্ষে ঘটনাটি মোটেও হাসির নয়। ‘‘খুকু ও কাঠবেড়ালী’’ কবিতায় একটি ছোট মেয়ে কাঠবেড়ালীর সঙ্গে গল্প করে—
‘‘ডাইনী তুমি হোঁৎকা পেটুক
খাও একা পাও যেথায় যেটুক
বাতাবি লেবু সকল গুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো
তবে যে ভারি ল্যাজ উচিয়ে পুটুস-পাটুস চাও
ছোঁচা তুমি তোমার সঙ্গে আড়ি আমার যাও।’’
এই কবিতায় অকৃত্রিম শিশুমন ধরা পড়েছে। ছোটদের কৌতূহল অদম্য। অজানাকে জানা অচেনাকে চেনার শিশুমন উৎসুক হয়ে থাকে। তাই নজরুলের শিশু মাকে বলে—
‘‘মা আমারে সাজিয়ে দেগো বাইরে যাওয়ার বেশে
রইবনা আর আঁচল ঢাকা গণ্ডী আঁকা দেশে।’’
সে কারণেই নজরুলের কিশোরের আকাঙ্খা—
‘‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে।’
শিশুমন কল্পনা প্রিয়। শিশুর কল্পনার জগতে নজরুল যে কত সাবলীল ভাবে ঘুরে বেড়াতেন তার আর একটি উদাহরণ—
‘‘আমি হব সকালবেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।’’
নজরুল অসাম্প্রদায়িক, ধর্মের গোঁড়ামি তিনি মানেন না, ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটকের একটি চরিত্রের মুখ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘হিন্দু-মুসলমান সব সমান। অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন।’’ এই নাটকেই আছে সেই বিখ্যাত গানটি—
‘‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’’
নজরুলের লেখা ‘পদ্ম গোখরা’ গল্পটি একসময় খুব সাড়া জাগিয়েছিল। রূপকথার ঢঙে লেখা এই গল্প ছোটদের ও বড়দের একই সঙ্গে তৃপ্তি দেয়। স্বপ্ন দেখেন সু¨র পৃথিবীর যে পৃথিবীতে অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা বাস করে; নেই দারিদ্র লাঞ্ছিত জীবনের যন্ত্রণা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘সহজ কথা যায়না বলা সহজে’’। ছোটদের জগৎ নিয়ে লেখা খুব সহজ ব্যাপার নয়। ছোটদের মন কল্পনাপ্রবণ, সংবেদনশীল। সেই মনে আনন্দ দেওয়া ছোটদের জন্য লেখার প্রাথমিক শর্ত। নজরুলের ছোটদের জন্য লেখার মধ্যে রয়েছে একটা নির্দেশ, একটা অনুচ্চ বাণী অথচ তা আনন্দের মোড়কে মোড়া। নজরুলের ছোটদের জন্য লেখা-সাহিত্য ছোটদের যেমন আন¨ দেয়, তেমনি এই সাহিত্য পাঠ বড়দেরও নিয়ে যায় তার হারানো শৈশবে।