ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
এবছর বর্ষা শুরুতে ঠিকমতো না হওয়ায় দাদুর ধানের বীজতলা তৈরী হতে বেশ দেরী হয়ে গেল। কোলকাতার স্কুলে তীব্র গরমে গরমের ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সুযোগে বাবা মার সঙ্গে শুভ্রনীল হাওড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে এসেছে।
একদিন ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। দাদু তাড়াতাড়ি লোকলস্কর জোগাড় করে বীজতলা থেকে ধানের চারা নিয়ে নিজের জমিতে রুইতে চলল। বৃষ্টি একটু থামতেই তালপাতার ডোঙা মাথায় দিয়ে শুভ্রনীল মাঠের দিকে চলল। দাদু আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা অতি দ্রুততার সঙ্গে জমিতে ধানের চারা রুইতে লাগল। দাদু হঠাৎ চিৎকার করে বলল, ‘‘বুঝলি শুভ্রনীল যখন ভাত খাবি বাংলার কৃষকদের স্মরণ করবি —যখন ঘুমুবি সীমান্তে সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবি। সৈনিক আর কৃষক আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি।’’ সামনে বহু বিস্তৃত মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে শুভ্রনীলের মনে হল ভারতবর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অলক্তা, মঞ্জরি, দেবাদৃতা, শরণ্যা, প্রত্যেকদিন সকালে তারা বাগানে ফুল তুলতে যেতে লাগল। শুভ্রনীল বলল, ‘‘জানিস অলক্তা, সেবার বাবা মার সঙ্গে বর্ষায় গাদিয়াড়ায় গিয়েছিলাম কিন্তু নিজের গ্রামে বর্ষায় দিন কাটানোর আন¨ই আলাদা। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে সাঁতার আর স্নান কেউ ভুলতে পারবে না। গ্রামের সবাই কেমন পাড় থেকে পুকুরে ঝাঁপিয়ে কয়েকবার এপার-ওপার করে জল ঘেঁটে চোখ লাল করে তবেই ঘাটের ওপর উঠে আসে। নিষেধে কোন বাঁধা নেই।’’
এই তো কিছুদিন আগে কলার ভেলায় চেপে শুভ্রনীল দিঘির মধ্যিখানে চলে গেল। তীরে দাঁড়িয়ে সবাই ‘ডুবে গেল ডুবে গেল’ বলে চিৎকার করতে লাগল। দাদু ফুৎকারে ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘‘শুভ্রনীল সাঁতার জানে। ডুবে যাবে না। ভুলে যাও কেন বিপদে ঝাঁপিয়ে না পড়লে সে লড়াকু হয়ে উঠে না। আতুপুতু করে মানুষ করলে বড় বড় পরীক্ষায় পাশ দিয়ে কাজ করে চুরি করবে। দেখছ না দেশে শিক্ষিত চোরের সংখ্যা বাড়ছে।’’
শুভ্রনীলের শেবার ঘরের সামনে থোকা টগর ফুলের গাছটায় প্রচুর ফুল ফোটে। কিন্তু সকাল হলেই সব ফুল চুরি হয়ে য়ায়। শুভ্রনীল ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। তাই তার বুদ্ধিতে বিশেষ ধার পড়েছে। সে বিকেলবেলায় বাড়ির যত বাতিল ঝুমঝুমিগুলো টগর ফুলের গাছে মোটা সুতো দিয়ে বেঁধে দিল। গাছের মোটা ডালটায় পেটো দড়ি বেঁধে লম্বা দড়িটাকে জানলা দিয়ে গলিয়ে দিল। ভোরে চোররা ফুল চুরি করতে আসতেই শুভ্রনীল ঘরের ভেতর থেকে ঘন ঘন দড়িতে টান দিতে লাগল আর নাকি সুরে ভূতের মতো হাসতে লাগল। চোর ভূত নাচছে মনে করে পগার পার হয়ে গেল।
তাদের তালবাগানে রাতের বেলায় পড়া তালগুলাকে কে কারা চুরি করে নিয়ে যেত। শুভ্রনীল দাদুর পোড়ো রণপাতে পা গলিয়ে ভোর ফোটার আগে তালবাগানে কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করে এল। চোরেদের মধ্যে রটে গেল তাল বাগানে লম্বু ভূত তাল কুড়োচ্ছে। তাল চুরি বন্ধ হল।
বাড়ির বড়োরা বকাবকি করতে লাগল, ‘‘হ্যাঁ রে ভূতের ভয় তোর নেই জানি। কিন্তু বাগানে রাতে সাপ খোপ তো অনেক আছে...’’ শুভ্রনীল হাসতে হাসতে বলল, ‘‘তোমরা শোননি দাদু গায়’’ ‘‘দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না...’’
শুভ্রনীলদের ধোপা পাড়ার মাঠে কয়েক বিঘা ধান জমি। গতবছর তাদের পাতা ঘুণি ঝেড়ে চোররা পালাতে শুরু করল। গতবছর দাদু বাবলা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল আর শুভ্রনীল গোরুর গলার কয়েকটা ঘণ্টি শরীরে বেঁধে সারা গায়ে সাদা কাপড় জড়িয়ে ভোরের আলো ফুটতেই হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চলল। চোররা মেছো ভূতের ভয়ে প্রাণভয়ে দৌড়ে শিবতলার আটচালায় গিয়ে হাপরের মতো হাঁপাতে লাগল।
গতকাল শহরে আসার পথে মুকুন্দদিঘির মোড়ে শুভ্রনীলের গ্রামের সব বন্ধু ও বন্ধুনীরা তাকে বিদায় জানাতে এলো। তাদের সব্বাইকে শুভ্রনীল বলল, ‘‘আকাশ যখন নীল সমুদ্র হবে আর তার বুকে যখন সাদা ভেলা ভাসবে সেই শরতে আমি আসব! বাবা বলে, দুর্গা হল জন্মভূমি। পুজোতে যে জন্মভূমিতে আসে না —সে লক্ষ্মীছাড়া হয়!’’