ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
রবিবার। ছুটির দিন। ভর সন্ধ্যাবেলা। বৈঠকখানায় যতীন দাদু বসেছিলেন। হাতে কফির পেয়ালা। গভীর আমেজে তিনি চুমুক দিচ্ছিলেন পেয়ালায়। এমন সময় নাতি-নাতনির দল হাজির। তারা গোল হয়ে বসে পড়ল যতীন দাদুর সামনে। সমস্বরে তারা আবদার করে বসল— দাদু! একটা গল্প শোনাও।
যতীন দাদু বললেন— হল্লা করিস না, গল্প বলছি। তবে কফিটা একটু আমেজ করে খেতে দে।
নাতি-নাতনির দল তাতেই সন্তুষ্ট। তবে কেউ চুপ করে বসে থাকার পাত্র নয়। এ ওকে সুড়সুড়ি দেওয়া, চুল ধরে টানা, চিমটি কাটা, কান ধরে টানাটানি শুরু করে দিল নিজেদের মধ্যে। তাদের কীর্তিকলাপ চোখ এড়াল না যতীন দাদুর। এটা যে তাদের একটা স্বভাব তা বুঝতে বিলম্ব হল না তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ে গেল কঙ্গো দেশের একটা লোকগল্পের কথা। কফিপর্ব একসময় শেষ করে তিনি একটু গুছিয়ে বসলেন। তারপর শুরু করলেন গল্প বলতে।
গল্পটা হলো একটা বানর ও একটা খরগোশের। দুজনে দুই প্রজাতির হলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বহুবছর ধরে। একসাথে গল্পগুজব করা, খাওয়া- দাওয়া করা, সব-ই করত তারা। কিন্তু একটা সমস্যা ছিল বিস্তর, কেউ কারোর বাড়িতে যেতে পারত না। কারণ বানরের বাসা ছিল গাছের ডালে। খরগোশের গাছে ওঠার সাধ্য ছিল না। আর খরগোশের বাসা ছিল গর্তের ভিতরে, সেখানে প্রবেশ করতে পারত না বানর। তা বলে তাদের বন্ধুত্বের কোন খামতি ছিল না।
গাছের ডালে বানরের বাসা হওয়ায়, বানর উপর নিচে সবটাই পরিষ্কার দেখতে পেত। ফলে কোন বিপদ আপদের আশঙ্কা বুঝলে বন্ধু ও অন্যান্য পশুপাখিদের সাবধান করে দিত। সাপখোপ বা মানুষের দ্বারা ক্ষতির সম্ভাবনা দেখলে খরগোশ সাবধান করে দিত বানরকে। এইভাবে গুজরান হতো তাদের দিন।
বানর বানিয় বানিয়ে ভালো গল্প বলতে পারত। তা শোনার জন্য প্রতিদিন অনেক পশুপাখি জড় হতো তার বাড়ির সামনে। তারা বানরের জন্য নানান রকম খাবার দাবার নিয়ে আসত। বানর তা সাদরে গ্রহণ করত। বন্ধু খরগোশকে তার ভাগ দিত। খরগোশও মাঝে মাঝে সেই আসরে গল্প শোনাত। বানরের মতো অত ভালো গল্প না বলতে পারলেও তা মন্দ লাগত না পশুপাখিদের।
একথা বলে যতীন দাদু একটু থামলেন। টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খেলেন। তারপর নাতি নাতনিদের মুখের দিকে চেয়ে বললেন— তোমাদের মতো একে অপরের কান ধরে, চুল ধরে টানা, চিমটি কাটার ন্যায় কিছুটা বদ-অভ্যাস ছিল বানরের। কোন কিছু কাজে ব্যস্ত থাকলেও সে মাঝে মাঝেই নিজের শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকে নিত। চুলকানো ছাড়া সে স্থির থাকতে পারত না কোনভাবেই। তার এই অস্বাভাবিক আচরণ বরদাস্ত হতো না খরগোশের। কিন্তু সৌজন্যতার খাতিরে বন্ধুবরকে কোনকিছু বলতে পারত না সে।
তবে খরগোশ যে একেবারে ধোওয়া তুলসিপাতা তা নয়। তারও কিছু বদ-অভ্যাস ছিল। সে তার লম্বা কান দুটো সর্বদা নাড়াচাড়া করত। কান খাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করত। মুখ উঁচু করে সবসময় বাতাসের ঘ্রাণ নিত। সশব্দে শ্বাস গ্রহণ করত। এসব দেখে বানরও মনে মনে বিরক্ত বোধ করত। কিন্তু বন্ধুত্বের কারণে সেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকত। কোনদিন কিছু বলত না খরগোশকে।
একদিন দুই বন্ধু বসে গল্প করছিল। যথারীতি গল্পের মাঝে মধ্যে বানর চুলকে নিচ্ছিল শরীরের নানান জায়গায়। তা দেখে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না খরগোশ। সে বলেই ফেলল— বন্ধু! তোমার ওই ক্ষণে ক্ষণে গা চুলকানোর বাজে বদ-অভ্যাসটা দেখলে আমার পিত্তি জ্বলে ওঠে। তুমি ওটাকে ত্যাগ করতে পারো না?
—পারি, অবশ্যই ত্যাগ করতে পারি। ইচ্ছে করলে আমি সবকিছু করতে পারি। কিন্তু বন্ধু! তুমি কি পারবে তোমার বদ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে?
—আমার আবার কিসের বদ-অভ্যাস? আকাশ থেকে পড়ার মত সবিস্ময় চোখে খরগোশ জানতে চাইল বানরের কাছে।
বানর বলল —এটাই হয়। নিজের বদ-অভ্যাস কি নিজের চোখে ধরা পড়ে কোনদিন? এই যে তুমি সারাক্ষণ কান দুটো নাড়াচাড়া করো, শ্বাস নিতে বিদখুটে শব্দ করো, এগুলো কি তুমি ত্যাগ করতে পারবে?
খরগোশ বলল —অবশ্যই পারব।
বানর বলল —তাহলে প্রমাণ হয়ে যাক।
খরগোশ বলল —কিভাবে?
বানর একটু ভেবে নিয়ে বলল —এমনি চুপচাপ বসে থাকলে আমরা দুজনেই খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ব। তখন আমরা আমাদের সেই বদ-অভ্যাসগুলো মনের অজান্তে করতে থাকব। তা থেকে নিÜৃñতি পেতে ওই সময়ে আমরা দুজনে দুটো গল্প বলব। সেই গল্পের মাঝে কেউ যদি ওই কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে এই প্রতিযোগিতায় সে পরাজিত হবে।
খরগোশ বলল —এ তো খুব ভালো কথা। হাতে হাতে প্রমাণ হয়ে যাবে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম গল্প বলতে শুরু করব?
বানর বলল —ঠিক আছে, আপত্তি নেই আমার।
একথা বলে খরগোশ একটু গুছিয়ে বসলো। তারপর শুরু করলো গল্প বলতে। এই কয়েকদিন আগের কথা। একদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ঘাসের মধ্যে দৌড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ নাকে এসে ঠেকল একটা গন্ধ। ব্যাপারটা কি তা বোঝার জন্য আমি মুখ উঁচু করে ইতিউতি তাকিয়ে দেখলাম। গভীরভাবে শ্বাস টেনে, কান দুটো নেড়েচেড়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম। আমার মনে হলো পশুরাজ সিংহ ওৎ পেতে বসে আছে ঘাসের মধ্যে। ভয়ে আমার গা-টা কাঁটা দিয়ে উঠল। পরক্ষণে মনে হলো, অতবড় সিংহ ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে কি করে? মনে সাহস সঞ্চয় করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে কি দেখলাম জানো? সিংহ নয়, একটা বাচ্চা শুয়োর মুখ নিচু করে ঘাস খাচ্ছে। আমি...!
—ঠিক আছে, ঠিক আছে। মাঝপথে খরগোশের গল্পের ইতি টেনে বানর বলল —বন্ধু! আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার নাক, কানের ধার অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে।
আসলে খরগোশের বলা গল্পের প্রতি যতটা না বানরের মনোযোগ ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ ছিল খরগোশ এর আচার-আচরণ দেখার। গল্প বলার অছিলায় খরগোশ তার বদঅভ্যাসগুলো অত্যন্ত সুচতুরতার সাথে সম্পন্ন করে নিচ্ছল কিন্তু তা দেখেও না দেখার ভান করে চুপচাপ থাকল। খরগোশ তাগাদা দিল।
—এখন তোমার গল্প শোনাও দেখি।
বানর আর বি¨ুমাত্র দেরি করল না, শুরু করল তার গল্প। গত পরশুদিন জঙ্গলের পার্শ্ববর্তী বস্তিপথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল একঝুড়ি পাকা ফল রাখা আছে রাস্তার ধারে। ফল দেখে আমার খুব খাবার লোভ হলো। আশেপাশে কোন লোকজন দেখতে না দেখে বীরদর্পে এগিয়ে গেলাম সেখানে। তারপর গোগ্রাসে শুরু করলাম খাওয়া। কোথা থেকে বস্তির লোকজন টের পেয়ে গেল। তারা দূর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। আমাকে লক্ষ্য করে ইঁটপাটকেল ছুঁড়তে শুরু করল। একটা ঢিল তো সরাসরি আমার মাথায় এসে পড়ল। সাথে সাথে মাথাটা ফুঠে উঠল। ব্যথায় টনটন করতে থাকল।
একথা বলে কয়েক সেকেন্ডে মাথাটা চুলকে নিলো বানর। কিন্তু গল্প বলা থামাল না। সে বলে চলল —শুধু মাথায় নয়, সেই ঢিল এসে লাগল আমার হাতে, পায়ে, সারা শরীরে।
এই কথা বলতে বলতে সারা শরীর চুলকে নিল বানর। তা দেখে ধৈর্যহারা বানর বলে উঠল —বন্ধু! তোমাকে আর গল্প শোনাতে হবে না। আমি বুঝে গেছি তোমার অভিসন্ধি। দেখে ফেলেছি তোমার কার্যকলাপ। গল্প বলার মাঝে তুমি চুলকে নিয়েছ তোমার সারা শরীর। এই বাজীতে তুমি হেরে গেছো। তুমি একটা জোচ্চর। জোচ্চুরি করে জেতার তালে আছো।
সে কথা শুনে একগাল হেসে বানর বলল— জোচ্চর বলে শুধু আমার দিকে আঙুল তুললে হবে? ভাবছ আমি কোন কিছু দেখিনি? গল্প বলার ফাঁকে তুমিও তো মাথা দুলিয়েছ, দু’কান ভাল করে নাড়িয়ে নিয়েছ। মুখ তুলে গভীরভাবে শ্বাস নিয়েছ। ভাবছো, কিছুই আমার নজরে পড়েনি। আমি মূর্খ, বোকার হদ্দ। তোমার চালাকি ধরতে পারিনি।
তা শুনে খরগোশ বলল —বন্ধু! সত্যি আমার দুজনে হেরে গেছি। আসলে আমরা সকলেই স্বভাবে, আদতে, বদ-অভ্যাসে মজবুর। এ জিনিস আমরা সহজে ত্যাগ করতে পারব না। তবে মানুষে বলে সাধ্যের অসাধ্য বলে কিছু নেই। আমরা চেষ্টা করে গেলে নিশ্চয়ই একদিন আমাদের এই বদ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে পারব।