ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
হঠাৎ ‘ছোটদের কথা’র সম্পাদিকা কল্পনাদির অনুরোধ না, নিদের্শ এল ‘ছোটদের কথা’র শারদ সংখ্যায় একটা লেখা দেবার জন্য। কতদিন আগে ছোটদের কথায় লিখেছি মনে পড়ে না। বলতে গেলে ছোটদের জন্য লেখা ছেড়েই দিয়েছি, শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতীতে লেখা দেওয়া বন্ধ করার পর। বড়দের জন্য লিখতে খুব একটা ভাবনা চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু ছোটদের বেলায়? অতিরিক্ত সতর্কতা দরকার হয়। না ভাবনা চিন্তা করলে লেখা আসে না। ছোটদের মনে একবার যা গাঁথা হয়ে যায়, তার থেকে বের করে আনা শক্ত। তাই ভাবতে হয়। ছোটরা হল গাছের বীজের মতো, প্রত্যেকের মহীরূর হবার সম্ভাবনা থাকে, সেজন্য সযত্নে এদের লালন করা উচিত। লেখাতে সেজন্য সতর্ক থাকতে হয়। তাই ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখি! নিজের ছোটবেলাতেই না হয় একটু ছুঁয়ে দেখব!
খুব ছোটবেলায় গ্রামের পাঠশালায় পড়েছি। একটা চাটাই, পাথরের শ্লেট আর খড়ি পেনসিল বইতেই গলদঘর্ম অবস্থা। অনেক পড়ে বর্ণপরিচয় আর ধারাপাত জুটেছিল। চাটাই ঘসটাতে ঘসটাতে পাঠশালায় যেতাম, বাজারের থলির মতো একটা ব্যাগ হাতের কব্জিতে বেঁধে ঘাড়ে চাপিয়ে। সানের পুকুরের পাড়ে পাঁচ ঘড়ার ডাঙায় পাঠশালা ছিল। এখন সেখানে প্রাইমারি স্কুল হয়েছে। ঠিক সেই জায়গায় নয় সানের পুকুরের পাড়ে, মল্লিকরা জায়গা দিয়েছিল। এই মল্লিক বাড়িতে পল্লীকবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বোনের বিয়ে হয়েছিল। ছোটখাটো ধবধবে ফর্সা চেহারার পাতলা সেই অন্নবাড়ির ঠাকুমা ছিলেন আমার ঠাকুমার পাতানো সই। কদমফুল। আদর করে নুনে জাঁক দেওয়া বাতাবি লেবু খাওয়াতেন।
না। পাঠশালায় পণ্ডিতমশাইয়ের লিকলিকে বেতের ভয় একদম ছিল না। তাঁর সদা হাস্যময় মুখ এখনও মনে জেগে আছে। তবে দুলে দুলে নামতা পড়তে হতো! ‘গোপাল বড় ভালো ছেলে’ ইত্যাদি সবাই খুব জোরে জোরে পড়তাম। গো-পা-ল গোপাল, ব-ড় বড়, ভা-লো ভালো, ছে-লে ছেলে, গোপাল বড় ভালো ছেলে। এরকম করে জোরে জোরে পড়তে হতো। পণ্ডিত মশাই বলতেন, আমাদের মুখ কোনটা?
আমরা হাত দিয়ে দেখাতাম, এই যে!
আমাদের কান কোথায়?
আমরা দেখিয়ে বলতাম, এই যে!
পণ্ডিত মশাই এবার জিজ্ঞেস করলেন, দূরত্ব কত? মুখ আর কানের দূরত্ব কত?
আমরা এ ওর মুখ চাওয়া চায়ি করে ভাবছি!
পণ্ডিত মশাই বললেন, মেপে বল?
আমাদের মধ্যে যে বেশ ঢেঁপো, জেঠামি করে, সে বললে এক বিঘত!
খুব কাছে তাই না? তাহলে পড়া পারিস না কেন? প্রশ্ন করলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকিস কেন? কারণ পড়াটা মাথায় ঢোকে না। জোরে জোরে পড়বি! জোরে পড়লে কানের ভেতর দিয়ে পড়াটা মাথায় ঢুকে যায়।
লেখাপড়ায় খুব ভালো ছেলে ছিলাম না। তবে পাস করতাম। পণ্ডিত মশাইয়ের কথাগুলো মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। ক্লাস ইলেভেন অব্দি জোরে জোরে পড়ার অভ্যেস ছিল। আর ছিল লুকিয়ে পড়া। কাউকে বুঝতে দেব না, কেমন পড়ছি, সবাই কেমন সবসময় বই মুখে করে বসে আছে। সামনে পরীক্ষা, বাবারে পড়তে হবে। দূর! অত কে খাটতে যায়, ফার্স্ট সেকেন্ড তো একজনই হয়। ক্লাসের সব ছেলে কি ফার্স্ট হয়? পাস করলেই হলো। বিদ্যের জাহাজ তো আর হব না।
একটু বড় হলাম, টাউন স্কুলে পড়ছি। স্কুলে একদিন পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হলো ‘লালুভুলু’। হাপুস নয়নে কাঁদলাম। আমিও ওদের মতো স্কুলের কারাগারে বন্দী হয়ে গেলাম। মাস্টারমশাই বললেন, আমাদের দেশের মানুষ খালি গায়ে থাকে, ওরা গরিব বলে নয়। এ দেশের আবহাওয়া গরম। তাই মানুষ খালি গায়ে থাকতে অভ্যস্ত। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের শুধু একটা চাদর, সারা বছরের সঙ্গী। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা চাদর ভরসা। জামা জুতো পড়া বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ছবি দেখেছিস?
ইউরোপের দেশগুলো শীত প্রধান। তাই সেখানকার মানুষকে সোয়েটার চাপাতে হয়। আমরা এখানে গরু, ছাগল পুষি, সাহেব বলে কি ওরা ডায়নোসর হাতি ঘোড়া পুষবে? ওরাও গরু, ছাগল পোষে। তবে তাদের চেহারাগুলো আমাদের এখানকার মতো নয়। এই ঠান্ডা গরম ব্যাপার স্যাপার গুলোই হল জলবায়ু। ভূগোল বোঝার জন্য এই শিক্ষাগুলোই দিকনির্দেশ করে দিল।
আমরা ভাত খাই, কারণ বাংলার জমি ধান চাষের উপযুক্ত। আমরা মাছ খাই, কারণ বাংলার নদী নালা খাল বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বাড়িঘর ইঁটের বদলে মাটি আর বাঁশের তৈরি, ঝড় বা বন্যায় ভেঙে গেলে তাড়াতাড়ি তৈরি করা যায়। ছিটেবেড়ার ঘর, ফুরফুরে বাতাস ঢোকে, গরমকালে সমস্যা হয় না। ভূগোলের এই শিক্ষাগুলো এখনও পথপ্রদর্শক। পরিবেশ জলবায়ু মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। আর মানুষ ইতিহাস তৈরি করে। আমাদের দেশের ইতিহাস আমাদের মতই হবে, বিলেতের মতো হবে না। ভূগোলের সাথে ইতিহাসের যোগ অবিচ্ছেদ্য। ইতিহাস মানেই রাজা রাজ্য রাজত্ব-যুদ্ধ। সবটাই ভূগোল নিয়ে। রাজ্য একটা সীমাবদ্ধ ভূখণ্ড, রাজত্ব সেখানকার মানুষ এবং শোষণ ব্যবস্থা। ভূখণ্ড নিয়ে গোলমাল মানেই যুদ্ধ।
ব্যাস ইতিহাস বোঝা হয়ে গেল। কিন্তু আসল ইতিহাস ছিল, হুমায়ুন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। সাজাহান তাজমহল বানিয়ে ছিলেন। মেবারের রানার চৈতক নামে একটা ঘোড়া ছিল। সেই ঘোড়ার গায়ের রঙ ছিল নীল। তাই তাকে ‘হে নীল ঘোড়েকি সওয়ার’ বলত সবাই। রানা প্রতাপের ঘোড়া চৈতক ইয়াব্বড় নদী এক লাফে পার হয়ে যেত। মোগল সৈন্যরা সে নদী পার হতে হতে চৈতক হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।
শিবাজীর বাঘ নখ ছিল। তরোয়ালের এক কোপে মোগলদের হাতির মাথা দু-টুকরো করে ফেলতেন। আওরঙ্গজেবের কারাগার থেকে বন্দী অবস্থায় ফলের ঝুড়িতে করে পালিয়েছিলেন। হর্ষবর্ধন নামে একজন দানশীল রাজা ছিলেন। সিরাজউদোল্লার তরোয়াল ছিল এত ভারী, তুলতে তিনজন লোক লাগতো। বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনের পুতুলগুলো কথা বলত। অশোক বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন কলিঙ্গ যুদ্ধের পর। আলেকজান্ডারের সেনাপতির নাম ছিল সেলুকাস! সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
এসব গালগল্প শুনতাম নানা জনের কাছে। বলা হতো সব সত্যিকথা, যা কি না ইতিহাস বইতে লেখা নেই। স্কুলের জন্মদিনে ‘মুকুট’ নাটক দেখেছিলাম। নাটকের যেটুকু মনে আছে, ঝলমলে রূপালী জরির পাড় লাগানো কালো পোশাকে আরাকানের রাজা। নদীর নাম ইরাবতী। নাটক শেষ হলে মঞ্চে পড়ে আছে শুধু ঝকমকে রাংতার মুকুট।
স্কুলের সেই দিনগুলোতে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না কোথায় আরাকান, আর কোথায় ইরাবতী নদী। শুধু খুঁজেছি; এই বইয়ে পাইনি, অন্য বইতে খুঁজেছি। কিন্তু সেই স্কুল লেভেল। জীবনে কেউ বলেনি তোকে ফার্স্ট হতে হবে, নইলে তোর জীবনে কিস্যু হবে না, গরু চরাবি। বাবার টাকা ছিল না টিউশনি দেবে, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। সারা জীবন তাই কি গবেট থেকে গেলাম? কিন্তু সেই ইরাবতী নদী, আরাকান রাজাদের কথা, মঞ্চে গড়াগড়ি দেওয়া রাংতার মুকুট, এখনও আমাকে টানে; তাড়া করে বেড়ায়। শুধু খুঁজে বেড়াই, একদিন হয়তো দেখা মিলবেই।