ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
নবম শ্রেণি, পলাশডিহা হাই স্কুল
রাজেশ এর ছোট্ট মধ্যবিত্ত পরিবার তার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা রাজকন্যাকে নিয়ে। আর্থিক স্বচ্ছলতা খুব বেশি না থাকলেও, দু-বেলা খেয়ে পরে বেশ আনন্দেই কেটে যায় তাদের। রাজেশ ও তার স্ত্রীর একমাত্র মেয়ে রাজন্যাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। সব মা-বাবাদের মতো তারাও চায় যে তাদের মেয়ে বড়ো হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক। রাজন্যা বাবার জন্য রাজকন্যা। খুবই মেধাবী ছাত্রী, তবে একটু ডানপিটে স্বভাবের। এ নিয়ে প্রায়ই তার স্ত্রী রাগ করে। যদিও রাজেশের এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তার মতে মেয়েদের একটু মারকুটে হওয়া দরকার। ইদানিং রাজেশ একটু চিন্তায় আছে কারণ, ডি.এস.পি-এর থেকে আবারও নোটিশ এসেছে বাড়িঘর সরিয়ে ফেলা হবে কারখানা তৈরীর জন্য। সত্যিই ঝামেলার ব্যাপার। এতগুলো মানুষকে বসতি থেকে তুলে দিলে তাদের খাদ্য সংস্থান হবে কেমন করে? যদিও রাজেশের চিন্তা মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে। এই করেই তো পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে বাচ্চাদের। এর ওপর আজ সকালের একটা খবর শুনে তো রাজেশের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে। আর জি.কর মেডিকেল কলেজের নারকীয় ঘটনা এখন লোকের মুখে মুখে। সত্যি, মানুষ কী করে এত নিষ্ঠুর হীন কাজ করতে পারে? ছিঃ!
এই প্রসঙ্গেই রাজেশের স্ত্রী বলে ওঠে—
‘‘কীসের অবস্থা দেশের। কী গো, মেয়েটাকে নিয়ে কিছু ভেবেছো? আজকাল যা ঘটছে, একা একা কোথাও ছাড়তেও ভয় করে। স্কুলে তবে...।’’
রাজেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে—
‘‘হ্যাঁ সেই তো। বুঝতেই পারছি। ঠিক আছে, চিন্তা করো না। কাল থেকে নাহয় আমিই ওকে স্কুলে দিয়ে নিয়ে আসবো।
আড়াল থেকে রাজন্যা বাবা-মার কথা শুনছিল। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সত্যিই জীবনটা অনেক কঠিন। মানুষের না আছে নিরাপত্তা আর না আছে স্বাধীনতা। পরদিন থেকে রাজেশ নিজেই রাজন্যাকে স্কুল দিয়ে আসে, আবার ছুটি হলে নিয়েও আসে। রাজন্যার ভালো না লাগলেও মুখে কিছু বলতে পারে না। কারণ সে জানে যে মা-বাবা ওর জন্যই এত চিন্তা করে, তবে সে চায় যে সে নিজেই নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক। এই ঘটনার কিছুদিন পর বাবাকে রাজন্যা জানায় যে সে ক্যারাটে শিখতে চায়। রাজেশ বেশ অবাক হয় কারণ, মেয়ে অন্যান্য বিষয়ে আগ্রহী হলেও খেলাধূলার বিষয়ে একেবারেই আগ্রহী ছিল না। তবুও সে হেসে রাজন্যাকে জিজ্ঞেস করে---
‘‘কেনো রে মা? হঠাৎ করে ক্যারাটে শিখতে চাস কেনো?’’
রাজন্যা উত্তর দেয়—
‘‘বাবা তুমি তো জানো যে আমি ডাক্তার হতে চাই। আর আমি যখন ডাক্তার হব তখন আমি চাই না যে আমার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠুক। নিজের জীবনই যদি না রক্ষা করতে পারি তবে ডাক্তার হয়ে অন্যের জীবন রক্ষা করব কেমন করে?’’
মেয়ের জবাব স্তব্ধ হয়ে যায় রাজেশ। সত্যি তো, সবসময় তো আর সে মেয়ের সাথে তাকে রক্ষা করার জন্য থাকতে পারবে না? আর স্বনির্ভর হওয়া মানে তো শুধু চাকরি করা নয়। সব দিক থেকেই সমানভাবে স্বনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। বেশি সময় নষ্ট করেনি রাজেশ। কিছুদিনের মধ্যেই সে রাজন্যাকে ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে আরও অনেকগুলো বছর। সেইদিনের সেই ছোট্ট রাজন্যা আজ একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। সবার সব কথা প্রত্যাখ্যান করে রাজেশ তার একমাত্র আদরের মেয়ের জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যে স্বপ্ন দেখেছিল তা আজ সফল হয়েছে। আজ সে সকলের কাছে মুখ উঁচু করে বলতে পারে যে সে সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিল। এইতো সেদিনের একটা খবর সবার মুখ হাঁ করে দিয়েছিল। হ্যাঁ, সেই রাজন্যা। যে এখন নামকরা হার্ট স্পেশালিস্ট ডা. রাজন্যা সরকার একটি অসহায় নাবালিকাকে রাতের অন্ধকারের দুটি নরপিশাচের হাত থেকে রক্ষা করেছে একাই। তার ক্যারাটে স্কিল-এর এক লাথিতে চোয়াল গুঁড়িয়ে দিয়েছে দিনের আলোয় ভালোমানুষের মুখোশ পরে থাকা দুটি শিকারী কুকুরের। শুধু নিজের নয়, অপর একটি মেয়েরও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে। আকাশে বাতাসে প্রতিফলিত হয়েছে বারবার---
‘‘বাবা আমি পেরেছি। সত্যি ডাক্তার হতে পেরেছি।
আজ আর আমার মনে কোনো ক্ষোভ নেই।
আজ আমি স্বাধীন। আমি সত্যিই প্রতিষ্ঠিত।’’