ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
সৌপর্ণ আজ ‘‘বীণাপাণি বিদ্যামন্দিরের’’ চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ক্লাস করতে চলেছে —না স্কুলের বাসে নয়, বাড়ির গাড়িতে নয় —বাড়ির কাজের লোক দামুদার হাত ধরে। মা বারংবার করে বলে দিয়েছেন এর আগে যে দুটো স্কুলে সে পড়েছে— ইয়াং ব্লসম আর টালিগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাই স্কুল —এই দুই স্কুলের সঙ্গে যেন কোন মিল খুঁজতে না যায় জুয়েল —আপাততঃ এই ‘‘বীণাপাণি বিদ্যামন্দিরেই’’ তাকে পড়তে হবে। সৌপর্ণ ওরফে জুয়েল ভাল ছেলের মত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে। দাদু-দিদাও যেন খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন —তাঁদের নাতির এই ভালমানুষীতে। দিদা আদর করে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে গালে হামি দিয়ে উইশ করেছেন আর দাদু শিরা ওঠা হাত দিয়ে যতদূর দেখা যার ততদূর পর্যন্ত টা টা করলেন।
চকচকে কালো মাইলেজ জুতো সাদা শার্ট, বাদামী হাফপ্যান্ট, পিঠে কিটস ব্যাগ ঝুলিয়ে টুকটুক করে হেঁটে সৌপর্ণ স্কুল গেটে পৌঁছে দেখল স্কুলের ভিতরে সামনে— তার মত অনেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে —সবাই যে যার মত টুকটাক কথাবার্তা বলছে, একে অপরকে ঠেলছে— বেশিরভাগের কাঁধে— কাঁধঝোলা, কারুর কারুর হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স। স্কুলের চেহারা সৌপর্ণের ঝকঝকে লাগল না —ছেলেদের তো নয়ই। দামুদা তাকে চতুর্থ শ্রেণি ক-বিভাগের সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল, বলল— ‘‘যাও, ভিতরে গিয়ে বস —ছুটিবেলায় আমি এসে তোমায় নিয়ে যাব।’’ ক্লাসের দুপাশে সার বাঁধা লম্বা লম্বা বেঞ্চ —হাই বেঞ্চ আর লো বেঞ্চ ক্রমান্বয়ে সাজানো —সামনে টিচারের চেয়ার আর টেবিল —গোটা চারেক বেঞ্চের পর সৌপর্ণ নিজের ব্যাগটা একটা ছেলের বইয়ের পাশে রাখল —নিজে বেঞ্চে ঢুকে বসতে যাবে এমন সময় স্কুলের ঘণ্টা বাজল টিং টিং টিং টিং —অনেকক্ষণ বেজে তারপর ঢঙ্। সৌপর্ণ আর বেঞ্চে ঢুকে বসতে গেল না —তার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল। ঘণ্টাবাদনের ক্ষেত্রে এই স্কুলে আর তার পুরানো স্কুলে একদম এক মিল খুঁজে পেল। হাসিমুখে ক্লাস থেকে বেরিয়ে সে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করল— ‘‘আমাদের অ্যাসেমব্লিটা কোথায় হয়?’’— ‘‘অ্যা-সে-ম-বি-লি’’ সেটা আবার কি? তৎক্ষণাৎ সৌপর্ণর মনে পড়ে গেল মা তাকে বলে দিয়েছিলেন— অ্যাসেমব্লির বাংলা প্রতিশব্দ প্রার্থনা সভা— তাই সে একটু থতমত খেয়ে বলল ‘‘প্রার্থনা মানে প্রার্থনাসভা’’। ছেলেটি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল— ‘‘ওঃ তাই বল প্রার্থনা, হুঁঃ চল ঘণ্টা পড়ে গেছে।’’ ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এল দুজনেই —সৌপর্ণ দেখল ছেলেটির —এদিকে ওদিক কোনদিকেই যাবার গরজ নেই। তাই সৌপর্ণ বলল —‘‘যাবে না?’’ —ছেলেটি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল— ‘‘কোথায় আবার যাব?’’ ক্লাসের সামনে মানে শ্রেণিকক্ষের সামনে আমরা দাঁড়াই— তা তুমি প্রার্থনা সঙ্গীতটা জান তো?’’ তখুনি ঢং করে একটা সজোরে ঘণ্টা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে যে গুন গুনানি চলছিল তা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ছাত্ররা সকলে একসঙ্গে গান ধরল— ‘‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর/হও উন্নত শির, নাহি ভয়’’ স্কেলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সৌপর্ণ গাইল পুরো গানটাই ‘‘জগজন মানিবে বিস্ময়’’। বলার পর সেই ছেলেটি সৌপর্ণর হাতে সামান্য চাপ দিল। প্রত্যুত্তর সৌপর্ণ সেই ছেলেটির হাতে সামান্য চাপ দিল —বোধহয় বোঝাতে চাইল জাতীয় সংগীত গাইবার সময় সঠিক ভঙ্গিমা। সেও জানে কিনা? —দুই গোড়ালি পরস্পর জোড়া, পায়ের সামনের অংশ ইংরাজী ‘ভি’ অক্ষরের মত কিছুটা ফাঁক রেখে —মাথা সোজা করে দাঁড়াতে হবে। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় দুপাশে থাকবে। সৌপর্ণ তাকিয়ে দেখল তার সামনের ছেলেটিও ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়েছে। জাতীয় সংগীত শেষ হবার পর আবার গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে —পায়ে পায়ে ছেলেরা নিজেদের ক্লাসে ফিরে যাচ্ছে। সেই ছেলেটিকে শুধাল সৌপর্ণ— ‘‘তোমাদের হেডমাস্টার মশাই প্রেয়ারের আগে কিছু বলেন না?’’ সৌপর্ণর প্রশ্নের উত্তরে সেই ছেলেটি বলল— ‘‘যেদিন কিছু বলার মত থাকে সেদিন বলেন, বলার মত না থাকলে আর কি বলবেন?’’ ছেলেটি এবার হেসে সৌপর্ণর দিকে তাকিয়ে বলল— ‘‘আমার নাম রঞ্জিত— রঞ্জিত মণ্ডল। তোমার নাম?’’ সৌপর্ণ নিজের নাম বলতে— ছেলেটি চওড়া করে হেসে বলল— ‘‘বেশ কঠিন উচ্চারণ তোমার নামের— আমি বরং তোমায় শুধু পর্ণ বলে ডাকব।’’ সৌপর্ণ হেসে সম্মতি জানাতে— দুজনে ক্লাসে ঢুকে পাশাপাশি বসে পড়ল। বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে এলেন একজন শিক্ষকমশায় হাতে লম্বা নাম ডাকার খাতা। সব ছেলেদের সঙ্গে রঞ্জিত, সৌপর্ণ উঠে দাঁড়াল— রঞ্জিত সৌপর্ণকে খেয়াল করল ছাত্ররা সবাই শিক্ষক মহাশয়কে দুহাত জোড় করে নমস্কার জানাচ্ছে— সৌপর্ণ বুঝল— তাদের গুডমর্ণিং স্যার পরিবর্ত হচ্ছে এই হাত জোড় করা নমস্কার। সঙ্গে সঙ্গে সেও আর সবার মত হাত জোড় করল। শিক্ষক মহাশয় হাতের ইশারায় তাদের বসতে বললেন। এক-দুই-তিন-চার করে ডেকে বিয়াল্লিশ-এ এসে তিনি থামলেন— বললেন, ‘‘আমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছে, তার রোল নম্বর তেতাল্লিশ— নাম সৌপর্ণ দত্ত। এই সৌপর্ণর সঙ্গে তোমরা সবাই বন্ধুভাবাপন্ন হবে— দরকার এবং সম্ভব মত আগের পড়া সব দেখিয়ে দেবে— ও যা জানতে চায় জানাবে— সৌপর্ণও নিশ্চয় তোমাদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন হবে। ক্লাসের সকল ছাত্র একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল— ‘‘হ্যাঁ স্যার’’। হকচকিয়ে সৌপর্ণ এই ‘হ্যাঁ স্যার’-এ যোগ দিতে পারল না। সবার হ্যাঁয়ে তার হ্যাঁ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়ে গেল। বাংলার স্যার এরপর ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-র লেখা ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন— কবিতার শেষ স্তবকটি শেষ হওয়ার আগেই পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ল— মাস্টারমশাই বললেন— আগামীকাল বাকী অংশ এবং অন্যান্য সব আলোচনা হবে। কিন্তু এই স্তবকটি তোমরা একবার শুনে নাও বলেই উদাত্ত কণ্ঠে পাঠ করলেন— ‘‘মোদের পিতৃ-পিতামহের চরণধূলি কোথায় রে?/সে আমাদের বাংলাদেশ আমাদেরি বাংলারে।’’ শিক্ষক মহাশয় রেজিস্ট্রার নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ছাত্ররা উঠে দাঁড়াল— সকলের মুখেই এক তৃপ্তির ছাপ— অনেকেই সৌপর্ণর দিকে তাকাচ্ছিল— একটা ছেলে সৌপর্ণর দিকে মুখ ভেংচে, কানে দুটো হাত লাগিয়ে লটপট করে নেড়ে দিল। সৌপর্ণ কিছু মনে না করে ছোট্ট করে হাসল— রঞ্জিত যতটা সম্ভব মুখ নামিয়ে বলল— ‘‘ওর সঙ্গে মোটেই ভাব কোরো না। সাংঘাতিক পাজি ছেলে— ওর দুষ্টুমির সঙ্গে পার পাওয়া ভার। পরের ক্লাসের মাস্টারমশাই ক্লাসে ঢুকেই চক-ডাস্টার নিয়ে বোর্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন— খস খস করে বোর্ডে একটা অঙ্ক লিখে দিলেন— ছেলেরা খাতা খুলে অঙ্কটা টুকতে শুরু করতেই মাস্টারমশাই বোর্ডে অঙ্কটা কষতে শুরু করলেন। অঙ্ক কষতে কষতে বোর্ডের দিকে মুখ করে তিনি কিছু কিছু জায়গা বুঝিয়েও দিচ্ছিলেন— একে বোর্ডের দিকে মুখ আবার ম্যাথামেটিক্যাল ওয়ার্ডসের বাংলা প্রতিশব্দ, সৌপর্ণ প্রায় আশিভাগই বুঝতে পারছিল না। প্রথম অঙ্ক শেষ হতেই গোটা বোর্ডটা মুছে দ্বিতীয় অঙ্কে চলে গেলেন মাস্টারমশাই— দ্বিতীয় অঙ্কের পর তৃতীয় অঙ্কে একইভাবে চলে গেলেন তিনি। তৃতীয় অঙ্ক শেষ হওয়ার মুখে ঘণ্টা পড়ল— অঙ্কর বাকীটুকু তাড়াহুড়ো করে শেষ করে মাস্টারমশাই বেরিয়ে গেলেন। সৌপর্ণ শুধু কেন? আরও অনেকেরই অঙ্কটা টোকা হয় নি— একটা ছেলে তাড়াহুড়ো করে গিয়ে বোর্ডটা মুছে দিল। রঞ্জিত বলল— ‘‘পর্ণ ভাবিস না, আমার অঙ্ক খাতাটা তোকে আজ বাড়িতে দিয়ে দেব। সৌপর্ণ আমতা আমতা করে বলল, ‘‘তার দরকার হবে না, মা নিশ্চয় অঙ্কটা কষে দিতে পারবে।’’ এর পরের পিরিয়ড ইংলিশ— শুনেই ভাল লাগল সৌপর্ণর। মাস্টারমশাই দেখতে বেশ চটপটে, মুখখানা হাসি হাসি— তিনি ক্লাসে ঢুকে চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে টেবলের উপর একটা চক ঠুকে বললেন— ‘‘এই টেবলটা সম্বন্ধে দুটো করে সেনটেন্স আমাকে বলবে— দরকার হলে খাতায় লিখে নিতেও পার— ফার্স্ট বেঞ্চের একজন বলল-— ‘‘দিস ইজ এ টেবল। ইট হ্যাজ ফোর লেগস।’’ এরকম আরও দু-তিন জন বলার পর মাস্টারমশাই বললেন— ‘‘নতুন ছেলে, এবার তুমি বল’’, নতুন ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে সে যে নতুন ছেলে বলে পরিচিত হতে চায় না— তার জন্য অনুচ্চ স্বরে জানাল— ‘‘আমি সৌপর্ণ— তারপর থেমে থেমে বলল— ইটস সারফেস ইজ ফ্ল্যাট। দেয়ার আর সাম চক্স অ্যান্ড অ্যা ডাস্টার অন দ্য টেবল।’’ ‘‘চমৎকার, চমৎকার’’ মাস্টারমশায়ের মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা বেরিয়ে এল। ইশারায় সৌপর্ণকে গুটি গুটি পায়ে ঝকঝকে অক্ষরে বাক্য দুটি লিখে নিজের জায়গায় ফিরে যেতে যেতে দেখল— সৌপর্ণকে মাস্টারমশায়ের এবংবিধ প্রশংসা কিছু ছেলের মোটেই ভাল লাগে নি। মাস্টারমশাই বাক্য দুটি আর একবার পড়ে দিয়ে সরাসরি ইংরাজী পাঠ্যপুস্তকে চলে গেলেন। বেশ খানিকক্ষণ পড়ানোর পর ঘণ্টা পড়ল। রঞ্জিত বলল— ‘‘এটা খেলার পিরিয়ড— অনেকেই চটপট জুতো পরিবর্তন করে কেডস পরে নিয়েছে— কেউবা জুতো খুলে রেখে খালি পায়েই মাঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।’’ রঞ্জিত বলল— ‘‘তুমি আমার কেডসটা পরতে পার’’ লাজুক মুখে সৌপর্ণ বলল— ‘‘আমি কাল কেডস নিয়ে আসব।’’ সৌপর্ণ কিন্তু জুতো খুলল না— চকচকে মাইলেজ পরে খেলার মাঠে গেল। একটা ছেলে সৌপর্ণকে এক ঠেলা দিয়ে বলল— ‘‘যা চামড়ার জুতো খুলে আয় লাটসাহেব।’’ সৌপর্ণকে লাটসাহেব বলা আবার জুতো খুলে আসতে বলা— সেপৗর্ণর মোটেই মনঃপুত হল না। সে খেলার মাঠের এককোণায় গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যে ছেলেটা ফার্স্ট পিরিয়ডে তাকে মুখ ভেংচেছিল সে কোথা থেকে বা হাতের পাঞ্জাটায় কালি মাখিয়ে সৌপর্ণর পিঠে একটা হাত এঁকে দিল— আর একজন বুকে একটা জলভরা বেলুন দিয়ে সৌপর্ণকে জড়িয়ে ধরল— অন্য একজন সৌপর্ণর চুলটা ঘেঁটে দিল। সৌপর্ণ বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে রঞ্জিত কিছু বলতে যাচ্ছিল কয়েকজন মিলে তাকে বলল— ‘‘যা তো তুই ক্লাসে গিয়ে বস। আমরা সবাই একটা করে নতুন বই পেয়েছি— আর ও শেষে ভর্তি হয়ে পাঁচটাই নতুন বই পেয়েছে।’’ ‘‘কি মামার বাড়ির আব্দার নাকি’’ —এই বলে একটা ছেলে যখন তার জুলপি টানতে যাচ্ছে সেই সময় ঘণ্টা পড়ল। ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠতেই সৌপর্ণ স্কুল গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। ভীষণ ভয় পেয়ে সে ভাবল— ‘‘এই রে এতক্ষণ তো একটা ক্লাসের একটা সেকশনের ছেলেরা ছিল— এবার তো গোটা স্কুল কথাটা মনে হতেই সে যেদিক দিয়ে স্কুল এসেছিল— তার উল্টোদিকের রাস্তা ধরে প্রায় ছুটছে ছুটতে যাচ্ছিল। সৌপর্ণর মিনিট পাঁচেক ছোটার পর সৌপর্ণ তার গতিবেগ কমিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলা শুরু করল— আরও কিছুক্ষণ চলার পর সৌপর্ণর চোখে পড়ল একটা পুকুর— পুকুরের চারধারে বড় বড় গাছ— পুকুরের জলে ছায়া ফেলেছে। কিন্তু খুব ভাল করে লক্ষ্য করে সে কোন পুকুরের ঘাট বা বসার মত জায়গা দেখতে পেল না। এতটা ছোটা এবং হাঁটার ধকলে সে না বসে আর পারছিল না তাই একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসল। পুকুরের জলে তাকিয়ে সে জলের মধ্যে মাছেদের ওঠানামা তাকিয়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে তার মনে হচ্ছিল সে যদি এই মাছেদের মত ওঠানামা করতে পারত তাহলে সে এক ডুবে তাদের বাড়ি পৌঁছে যেতে পারত। কতক্ষণ সে পুকুরপাড়ে বসেছিল তার সঠিক হিসাব সৌপর্ণর কাছে ছিল না। ঘোর কাটল দামুদার ডাকে— ‘‘ছোটবাবু, তুমি ইসকুল ছেড়ে এখানে’’। দামুদাকে দেখে সৌপর্ণর চোখ ফেটে জল আসে আর কি? কোনরকমে চোখের জল চোখে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। দামু সৌপর্ণর হাত ধরে ফেলে আসা পথ ধরল— সৌপর্ণর সন্দেহ হচ্ছিল দামুদা তাকে ধরে আবার ইসকুলে দিয়ে আসবে। কিন্তু ইসকুলের ধারে কাছে না গিয়ে শর্টকাট পথ ধরে বাড়ি পৌঁছাল। বাড়িতে তখন কেউ সৌপর্ণকে আশা করে নি— তবে বাড়ির কড়া নাড়তেই মা দরজা খুলে দিলে। দরজা খোলার আওয়াজে দাদু-দিদা দুজনেই বেরিয়ে এলেন। নাতির অবস্থা দেখে দুজনেই হতভম্ব। মা ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়াতেই দুজনে আর কিছু বললেন না। মা বললেন— ‘‘যাও। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে জামা-কাপড় পাল্টে এস। সৌপর্ণ জামাকাপড় পাল্টাবার কথায় যেন বাঁচল। ওঁরা তিনজন পরস্পরের সঙ্গে আলোচনায় এরকম অবস্থার কোন কারণ খুঁজে পেলেন না— দামুও ক্লাসে বইয়ের ব্যাগ পড়ে থাকা ও সৌপর্ণার পুকুর পাড়ে বসে থাকার বাইরে কিছু বলতে পারল না। কোন রকমে এক গ্লাস দুধ খেয়ে সৌপর্ণ নিজের বিছানায় গিয়ে বসল। মা শুয়ে রেস্ট করতে বললেন। সেদিন রাতে কোন কিছু জিজ্ঞেস করলেন না— যে যার মত করে ভেবে নিলেন। পরদিন সকালে উঠে সৌপর্ণ স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে স্কুলে যাবে না। মা, দাদু, দিদা কারোর কথাতেই, কিন্তু কি হয়েছে তাও সে কিছু বলতে নারাজ। তবে কিছু যে একটা ঘটেছে সে বিষয়ে তিনজনই নিশ্চিত। পরদিন সকালে উঠে সৌপর্ণর ঘোষণা— ‘‘আজ শুধু নয়— আর কোনদিন আমি ওই স্কুলে যাব না।’’ —সৌপর্ণর মা বললেন —‘‘ঠিক আছে —আমি হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আসব।’’ মা স্কুল বসার আধ ঘণ্টা পরে স্কুলে গিয়ে পৌঁছালেন। হেডমাস্টারমশাইয়ের কানে সব কথা না পৌঁছলেও ঘটনাটা সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন— তিনি সৌপর্ণর মাকে আশ্বস্ত করলেও সৌপর্ণর মা নিজেই আশ্বস্ত হতে পারলেন না। বাড়ি ফিরে তাঁদের আবাসনের বিনায়কবাবুকে ফোন করলেন। বিনায়ক তাঁর নিজের ছেলে সুপ্রতিম ও সৌপর্ণর সঙ্গে বন্ধুর মত মিশতেন— যেটা একদমই পারতেন না সৌপর্ণর ফৌজি বাবা। বিনায়কবাবু ব্যাপারটা জেনে সেদিনই সৌপর্ণদের বাড়ি আসবেন বললেন। দুপুরের একটু পর পরই বিরাট মোটর বাইক চালিয়ে সৌপর্ণদের বর্তমান বাড়িতে পৌঁছালেন। সারাক্ষণ সৌপর্ণর সঙ্গে কাটিয়ে তিনি সৌপর্ণর মনের ভাব কিছুটা আন্দাজ করলেন। রাত্রিতে সৌপর্ণর বিছানায় তার পাশে শুয়ে অনেক কথা জানতে পারলেন। পরদিন সকালে সৌপর্ণর মনের গুমোট মনে হল অনেকটাই কেটেছে। বিনায়কবাবু একবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন— ‘‘যার বাবা ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধে গেছে তার ছেলের সঙ্গে মস্করা’’ —এই কথাটা জুয়েল তোর স্কুলের ছেলেদের বলতে পারিস নি— যাইহোক স্কুলের জন্য তৈরী হও। আমি তোমাকে আজ ইসকুলে দিয়ে আসব।’’ সৌপর্ণর জন্য মা দু-সেট ড্রেস তৈরী করিয়েছিলেন— অপর সেটটা পরে কাকুর বিশাল বাইকে চেপে সৌপর্ণ স্কুলে গেল তখন বাড়ির অন্য চারজন প্রার্থনা করল যাতে দিনটা ভালয় ভালয় কাটে। বিশাল বাইকের গুরুগম্ভীর আওয়াজে কিছু ছেলে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এল। বিনায়কবাবু সৌপর্ণকে বিড়াল ছানার মত নামিয়ে দিয়ে গলা নামিয়ে বললো, ‘‘দামুকে আমি গিয়েই পাঠিয়ে দিচ্ছি— ও সারাদিন একটু তফাতে বসে থাকবে— কেউ তোমার সঙ্গে অসভ্যতা করলে জানাবে আমি তাকে ধাড়াপুকুরে চুবিয়ে কদম গাছে শুকোতে দিয়ে দেব।’’ কাকুর কথায় ফিক করে হাসল সৌপর্ণ, হেসে কাকুর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কাকু বাইকের ডিকি থেকে বের করে এক প্যাকেট চকলেট সৌপর্ণর হাতে দিয়ে বললেন— ‘‘বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খেও— পঞ্চাশ পিস আছে।’’ সৌপর্ণকে দেখে রঞ্জিত এগিয়ে এসেছিল— সৌপর্ণ ওর হাতে চকলেটের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে কাকুকে টা টা করতে শুরু করল— বিনায়ক কাকুর বাইক বিশাল গর্জন করে ফেরার পথ ধরল। অন্যান্য ছেলেরা এগিয়ে আসতে রঞ্জিত সৌপর্ণর হাত ধরে টানল— সৌপর্ণ অন্য একটা ছেলের গলায় নিজের জলের বোতলটা ঝুলিয়ে দিল। রঞ্জিত সৌপর্ণকে বলল— ‘‘তুমি জল খাবে না?’’ সৌপর্ণ বলল— ‘‘সেদিন যে কিছু ছেলে বলল— দুটা জলের কল থাকা সত্ত্বেও গলায় জলের বোতল?’’ বাড়ি থেকে দিয়েছে তাই আমি নিয়েছি— আমিও কলের জল খাব।’’
প্রথমদিন যে ছেলেটি দু’কানে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে ল্যাতপ্যাত করে নেড়েছিল— তাকে দেখে সৌপর্ণ সেদিনের মত কানে আঙুল ঢুকিয়ে নাড়তেই— ছেলেটি তার দিকে ছুটে আসছিল— সৌপর্ণ কান থেকে আঙুল বের করে বুড়ো আঙুলটা দেখাল। এই বুড়ো আঙুল দেখানোর দুটো মানে হয়— (১) তুই আমার কাঁচকলা করবি (২) ভাব। সৌপর্ণর কাছাকাছি হয়ে সেই ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিল— ‘‘আমি মর্তুজা— তোকে কে নামিয়ে দিয়ে গেল তোর বাবা?’’ সৌপর্ণর সহাস্য উত্তর ‘‘দূর বোকা— আমার বাবাকে কোথায় পাবি? আমার বাবা তো ইজয়ারেল-প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে গেছেন। কলকাতায় আমাদের আবাসনে পাশাপাশি ফ্ল্যাট। ভারি মজার মানুষ বিনায়ক কাকু। সৌপর্ণ আর মর্তুজার হাত মেলানো দেখে আরও কেউ কেউ এগিয়ে এল। গতকাল রাতে বেশ ভারীরকম বৃষ্টি হয়েছে— এখন আবার পাউডারের মত বৃষ্টি ঝরছে— ক্লাসে যাবার গরজ কারুর না দেখে সৌপর্ণ ক্লাসে যাবার ভাব দেখালো না। বরং একটা গর্ত মত জায়গায় কিছুটা কাদা আর জল জমেছিল— সাদা মোজা সমেত চকচকে মাইলেজ জুতো সেই কাদাজলে ডুবিয়ে সে হাসিমুখে অন্যান্যদের দিকে তাকাল। রঞ্জিত ওর হাত ধরে টানলে— কাদামাখা পা-টা তুলে অপর পা-টা গর্তয় ডুবিয়ে দিল। রঞ্জিত বলল— ‘‘পর্ণ, জুতোটাতো বরবাদ করলে, এই গুঁডো গুঁড়ো বৃষ্টিতে তোমার পুরো পোশাকটাই নষ্ট হয়ে যাবে।’’ সৌপর্ণ কেমন যেন রহস্যময়— ‘‘তোমরাও ভিজছে— একা আমার পোশাক নষ্ট হবে কেন?’’ অন্য ছেলেরা যারা কাছাকাছি ছিল— তারা বলে উঠল— ‘‘হুররে সৌপর্ণ, হুররে।’’ রঞ্জিত চকলেটের প্যাকেট তুলে ধরে সবাইকে দেখাল— ‘‘পর্ণ এনেছে, আমাদের সবার জন্য।’’ আবার এক দফা ‘হুররে’। সৌপর্ণ এবার দুহাত তুলে জোরে বলে উঠল— ‘‘থ্রি চিয়ার্স ফর বীণাপাণি বিদ্যামন্দির— ক্লাস ফোর-এ। হিপ-হিপ হুররে’’, ‘‘হুররে, হুররে’’ সমবেত উচ্চারণে বীণাপাণি বিদ্যালয়ের অন্যান্য ছেলেদের মিশে এক হয়ে যায় সৌপর্ণ।